Image description
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সুপারিশমালা নিয়ে রাজনৈতিক বাদানুবাদের ডামাডোলে বহুল আলোচিত এই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। নিজেদের দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়াই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে বিএনপি ক্ষোভ প্রকাশ করলেও আলোচনার দরজা বন্ধ করছে না। দলটি চায়, আলোচনার ভিত্তিতেই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়টির সন্তোষজনক সুরাহা হোক। তাদের প্রত্যাশা, এ বিষয়ে সরকার যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবে এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফের আলোচনায় বসবে। আর সরকার এ ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে কিংবা ডাকলে বিএনপি তাতে সাড়া দিয়ে নিজেদের দলীয় অবস্থান আবারও তুলে ধরবে।

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা আছে অন্তর্বর্তী সরকারের। সে সময়সীমার মধ্যেই নির্বাচনটা হোক, সেটাই চায় বিএনপি। তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য চলতি নভেম্বর মাসের মধ্যেই গণভোট আয়োজনের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি রাজনৈতিক দল। দাবি আদায়ে জামায়াত এরই মধ্যে কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে। তবে এই ইস্যুতে বিএনপি এখনই পাল্টা কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। দলটি এমন কোনো অবস্থান নিতে চায় না, যাতে করে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ আলোচনায় অর্জিত অগ্রগতি ভণ্ডুল হয়ে যায়। দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে, তার ভিত্তিতে এর সফল সমাপ্তি চায় বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, মতভেদ থাকলেও জুলাই সনদে তারা এরই মধ্যে স্বাক্ষর করেছেন এবং এর আইনি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী হবে, সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘মতভেদ থাকলেও মূল যে সনদ, সেই সনদে আমরা স্বাক্ষর করেছিলাম। এটাই নিয়ম যে, আমরা যদি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাই, মানুষ যদি আমাদের ভোট দেয়, তাহলে আমরা সেই বিষয়গুলো আবার সামনে নিয়ে আসব। সেটাকে আমরা পার্লামেন্টে পাস করে দেশের যে পরিবর্তন, সেই পরিবর্তনটা নিয়ে আসব।’

বিএনপি মনে করছে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন যৌক্তিকভাবে একই দিনে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবে। এর স্বপক্ষে গতকাল দলের মিডিয়া সেলের এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজন করা যৌক্তিক, সাশ্রয়ী ও বাস্তবসম্মত। জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো ভোট আয়োজন কঠিন। কারণ, গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি জাতীয় নির্বাচনের মতোই ব্যাপক। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট সম্ভব। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের দিনে প্রত্যেক ভোটারকে দুটি ব্যালট দিলেই গণভোটও সম্পন্ন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই; শুধু ব্যালট পেপার ছাপানো ও ভোটকেন্দ্রে কিছু অতিরিক্ত কক্ষ সংযোজন করলেই যথেষ্ট। তা ছাড়া একই দিনে দুটি ভোট সম্পন্ন করা গেলে সরকারের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বাঁচবে।

দলটি এও মনে করছে, আগে গণভোট করলে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর নির্বাচন পিছিয়ে গেলে গণঅভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটাও ব্যাহত হতে পারে। কারণ, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পক্ষ বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করে দিতে ওতপেতে রয়েছে। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হওয়াই যৌক্তিক।

দীর্ঘ আলোচনার পর রাজনৈতিক দলগুলো গত ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ থেকে যায়। এমন অবস্থাতেই গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা তুলে দেন। সরকারকে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে এতে। সুপারিশে বলা হয়েছে, ওই আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করবে। গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো এই সময়ের মধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।

সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার পরপর দুদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। নেতারা মতামত দেন যে, যেসব সংস্কার প্রস্তাবে তারা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে সেটা রাখা হয়নি। বিএনপি এটিকে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা-বিশ্বাসঘাতকতা বলছে। তবে দলটি এমন কোনো অবস্থান নেবে না, যেখানে ‘বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে কিংবা বিএনপি সংস্কার চায় না’—এমনটা প্রতিফলিত হয়। এ কারণে সুপারিশ নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ থাকলেও সেটি প্রত্যাখ্যান করেনি। কারণ, প্রত্যাখ্যান করলে নির্বাচন বানচালের অজুহাত তৈরি হতে পারে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বিএনপিকে ‘সংস্কারবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ নিতে পারে। বিএনপিকে সংস্কারের বিপক্ষের দল হিসেবে এরই মধ্যে উপস্থাপন করা হচ্ছে; কয়েকটি রাজনৈতিক দল এটা বারবার ‘ব্র্যান্ডিং’ করতে চাচ্ছে।

দলের নেতারা বলছেন, সংস্কার বাস্তবায়নে বিএনপি হচ্ছে সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার (অংশীজন)। তারা বাস্তবতার আলোকে রাষ্ট্র কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার চায় এবং এটা তাদের অঙ্গীকারও। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারের এই সংস্কার উদ্যোগের অনেক আগে থেকেই তারা সংস্কারের প্রসঙ্গটি সামনে এনেছে। এর অংশ হিসেবে তারা ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি দিয়েছে। ক্ষমতায় গেলে যেটি তারা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবে।

দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে কমিশনের সুপারিশের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। সেখানে ওই সুপারিশমালাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সুপারিশে যেসব বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়নি, তা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সব সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমরা একমত হতে পারছি না।’

তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে আরও বলেন, ‘এসব সুপারিশ শুধু জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে। মনগড়া যে কোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘমেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।’

বিএনপির এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঐকমত্য কমিশন কিংবা সরকারের নীরব না থেকে একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘সরকার বা কমিশন থেকে কোনো ব্যাখ্যা না আসায় এটা নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে; তা ছাড়া সরকার ও কমিশনেরও নিশ্চয়ই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি রয়েছে। যদি অভিযোগটা ঠিক না হয়, তাহলে তারা একটা ব্যাখ্যা দেবে। আর অভিযোগ যদি ঠিক হয়, তাহলে বিএনপির সঙ্গে সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের কথা বলা দরকার। সে ক্ষেত্রে বলা দরকার—কেন, কোন পরিপ্রেক্ষিতে, কীভাবে এটা পরিবর্তিত হয়েছে। কারণ, বিএনপি সনদে স্বাক্ষর করেছে। তাদের সম্মতি ছাড়া পরিবর্তন হওয়া উচিত নয়। তবে যদি ঐকমত্য কমিশন মনে করে সম্মতির প্রয়োজন নেই, সে ব্যাখ্যাও কমিশন দিতে পারে।’

এক প্রশ্নের জবাবে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের ব্যাপারে এরই মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে অন্য কোনো পক্ষ হতে পারে, যেমন সরকার। যেহেতু সুপারিশমালা এখন সরকারের কাছে, আলাপ-আলোচনার জায়গাটাও সরকারকে দেওয়া হয়েছে। সেহেতু বৃহত্তর স্বার্থে সরকার গণভোটের সময় নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক নিরসনে আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারে।’

বিএনপি মনে করে, দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে যেসব সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর আলোকেই জুলাই সনদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আর যেগুলোতে ঐকমত্য হয়নি, সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে রাখতে পারে। জনগণ তাদের সমর্থন জানালে, সরকার গঠন করলে পরে তারা সেটা বাস্তবায়ন করবে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ কালবেলাকে বলেন, ‘দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে যেসব সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, তার ভিত্তিতে নোট অব ডিসেন্টসহ প্রণীত জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিএনপি অঙ্গীকারবদ্ধ। আর জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে, এটাই বিএনপির অবস্থান।’