Image description
উদ্যোগের নবায়ন

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। মূলত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ডিপো তৈরির উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এই কাজের সূচনা হয়েছিল। কথা ছিল, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে। এরপর যাত্রী নিয়ে কাঞ্চন থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ছুটবে এই মেট্রো ট্রেন। কিন্তু বাস্তবে গত এক বছরে মেট্রোরেল নির্মাণকাজে কোনো অগ্রগতি নেই। এখনো সব কাজের চুক্তি সম্পন্ন করতে পারেনি সরকার। সরকারি নথিতেও স্বীকার করা হয়েছে যে, কাজ সংকুচিত হচ্ছে। মুখে বলা হচ্ছে ব্যয় কমানোর কথা, কিন্তু কীভাবে কমানো হবে—তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা বাস্তবায়ন পথ দেখানো হয়নি। ফলে পাতাল মেট্রোরেলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়েছে, এবং যাত্রীসেবা চালু হতে আরও অন্তত ১০ বছর সময় লাগতে পারে।

নির্মাণকাজ বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সূত্র জানায়, আগের সরকারের করা কিছু চুক্তি নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংশয়ে রয়েছে। এই কারণে ঠিকাদার নিয়োগ হলেও চূড়ান্ত চুক্তি হচ্ছে না, ফলে কাজও এগোচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ চায়, সব প্যাকেজের চুক্তি শেষ করে একসঙ্গে নির্মাণকাজ শুরু করতে। ব্যয় কমানোর ফয়সালায় প্রয়োজনে জাপানের সঙ্গে ঋণ চুক্তি বাতিলের কথাও ভাবছে সরকার। এ জন্য নতুন অর্থায়নের পথ খোঁজা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার শুধু বড় প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের কথা বলছে, কিন্তু কীভাবে ব্যয় কমানো হবে—সেই রূপরেখা দিচ্ছে না। প্রকল্প দীর্ঘায়িত হলে ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। নতুন বিনিয়োগকারী এলে সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা পরিবর্তনের কারণে কাজ অনেক পেছাতে পারে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর ডিএমটিসিএলের পরিচালনা পরিষদের ৭১তম সভায় (সভাপতি তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক, বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব) বলা হয়, ঠিকাদাররা প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাবে (ডিপিপি) নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করছে। এ অবস্থায় জাইকার অনুমতি নিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

মেট্রোরেল লাইন-১ ও ৫ (উত্তর ও দক্ষিণ)-এর কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে, এবং নিকট ভবিষ্যতে পূর্ণমাত্রায় কার্যক্রম শুরু হওয়ার সম্ভাবনা কম—এমন মন্তব্য পাওয়া গেছে ডিএমটিসিএলের সর্বশেষ সভার কার্যবিবরণীতে। তাতে বলা হয়েছে, এমআরটি লাইন-১-এর কাজ ২০২৬ সালে এবং লাইন-৫ (উত্তর)-এর কাজ ২০২৮ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ডিপোর ভূমি উন্নয়নসংক্রান্ত প্যাকেজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘আমাদের আপত্তি এক জায়গায়—এই প্রকল্পগুলো ব্যয়বহুল। আমরা প্রকল্প করি জাতীয় সম্পদ বাড়ানোর জন্য; কিন্তু ব্যয় বেশি হলে জাতীয় সম্পদ বরং কমে যায়।’

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুখ আহামেদ বলেন, ‘আগে যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটা অযৌক্তিক ছিল। মেট্রোর কাজ শুরুর পর ছয় থেকে সাত বছর সময় লাগে—এটা নিয়ম। মেট্রোর কাজ থেমে নেই, তবে কিছু কাজ পিছিয়েছে। কৌশলগতভাবে সব চুক্তি প্রস্তুত করে তারপর একসঙ্গে কাজ শুরু করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এমআরটি এই দেশে হতেই হবে, তবে স্মার্ট ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে। আমাদের ঋণে প্রচুর শর্ত আছে, কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ডিএমটিসিএল নতুন প্রতিষ্ঠান—উত্তর-মতিঝিল মেট্রো দ্রুত চালু করতে গিয়ে পর্যাপ্ত পরীক্ষার সুযোগ ছিল না। জোর করে চালু করায় এখন আমরা তার ফল ভোগ করছি। খরচ কমাতেই হবে, না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে।’

বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ব্যয় বেশি—এটা তখনই বলা যাবে যখন ব্যয় কমানোর স্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যাবে। মুখের কথা নয়, পরিকল্পনা দরকার। আগের প্রস্তাবে সাড়ে পাঁচ বছরে মেট্রো শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন সাত বছর লাগবে, আর নতুন বিনিয়োগকারী ও নকশা পরিবর্তনে আরও আড়াই বছর যাবে। অর্থায়ন খুঁজে ঋণ চুক্তিও সময়সাপেক্ষ। সব মিলিয়ে ১০ বছরেও পাতাল মেট্রো বাস্তবায়ন কঠিন।’

রাজধানীর কাঞ্চন সেতু থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ৩১.২৪ কিলোমিটার পথটি মাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-১ নামে পরিচিত হবে। এর মধ্যে ১৯.৮৭ কিলোমিটার মাটির নিচ দিয়ে, বাকি ১১.৩৭ কিলোমিটার উড়ালপথে যাবে। ২০২৬ সালে কাজ শেষ হলে প্রতিদিন প্রায় আট লাখ যাত্রী চলাচল করতে পারতেন। এতে যানজট, জীবাশ্ম জ্বালানি ও সময় ব্যয়—সবই কমত।

প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা) দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি ৩২ লাখ, আর সরকার ১৩ হাজার ১১১ কোটি ১১ লাখ টাকা দেবে। বিমানবন্দর রুটে ১২টি পাতাল স্টেশন থাকবে—বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, কমলাপুরসহ। পূর্বাচল রুটে থাকবে ৯টি উড়াল স্টেশন—নতুনবাজার, বোয়ালিয়া, স্টেডিয়াম ও পূর্বাচল টার্মিনালসহ।

প্রথমে ৮ কোচবিশিষ্ট ২৫ সেট মেট্রো ট্রেন চালু করা হবে, ভবিষ্যতে ৩৬ সেটে উন্নীত করার সুযোগ থাকবে। প্রতিটি ট্রেন ২৫ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর, আর ২১ মিনিটে নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল টার্মিনাল পৌঁছাতে পারবে।

প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। তখন বিস্তারিত জরিপ, নকশা এবং ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হয়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৯৩ একর জমিতে ডিপো নির্মাণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কাজ তত্ত্বাবধানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগও প্রায় চূড়ান্ত।

তবে সূত্র জানায়, গত চার মাসে কোনো ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি ডিএমটিসিএল। বিভিন্ন প্যাকেজের কাজ আট মাস ধরে বন্ধ। ফলে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনিচি গত ২৩ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকা মেট্রো প্রকল্পগুলো জাপান-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার মূল অংশ। জাপান এগুলো সময়মতো শেষ করতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। জাইকার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এমআরটি লাইন-১ আন্তর্জাতিক মানে আর্থিকভাবে কার্যকর। ব্যয় বৃদ্ধি যুক্তিসংগত, কারণ এটি মুদ্রাস্ফীতি ও নকশা সমন্বয়ের ফল।’

এ বিষয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘আমরা জাপান রাষ্ট্রদূতের চিঠি পেয়েছি, জবাব প্রস্তুত করা হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেট্রো নির্মাণের ব্যয় তুলনা করে পর্যালোচনা চলছে। আমাদের মনে হচ্ছে ব্যয় বেশি, তাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আলোচনা হচ্ছে।’

প্রকল্পের বর্তমান ধীরগতিতে সরকার, বিনিয়োগকারী ও বিশেষজ্ঞ—সব পক্ষের মধ্যেই এখন প্রশ্ন একটাই—পাতাল মেট্রোরেল কি আদৌ ১০ বছরের মধ্যে যাত্রী নিতে পারবে?