দুর্বল ফায়ার সেফটি, অসম্পূর্ণ টার্মিনাল, অপ্রস্তুত লাগেজ হ্যান্ডলিং এবং নিরাপত্তা ও ইমিগ্রেশন ঘাটতি নিয়েই ‘আন্তর্জাতিক’ ঘোষণা হয় কক্সবাজার বিমানবন্দর। ইতোমধ্যে উন্নয়ন কাজে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও পূরণ হয়নি আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) শর্ত। তবুও ‘জোর করেই’ দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। যদিও তা স্থায়ী হয়নি, মাত্র ১১ দিনের মাথায় পিছু হটে সরকার। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি স্থগিত হয় এই বিমানবন্দরের। আকস্মিক এই ইউটার্ন নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিভিন্ন মহলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘাটতি রেখে বাস্তবতা মূল্যায়ন ছাড়াই নেওয়া সিদ্ধান্ত সরকারের পরিকল্পনাহীনতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার প্রতিফলন। এ সিদ্ধান্তে হতাশ পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
বেবিচক সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে ইতোমধ্যে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৬,৭৭৫ ফুট থেকে ৯,০০০ ফুটে বাড়ানো হয়েছে এবং প্রস্থ বাড়িয়ে ২০০ ফুট করা হয়েছে। আরেকটি প্রকল্পে একে সমুদ্রের ভেতর ১০,৭০০ ফুট পর্যন্ত সম্প্রসারণের কাজ চলছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) এটিএম নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মানে উন্নীত করতে ফায়ার সেফটি, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, সিকিউরিটি সার্ভিস, কার্গো পরিবহণ ও যাত্রী আগমন-বহির্গমন পৃথক ব্যবস্থা অপরিহার্য। এসব মান পূরণ করলেই আইকাও অ্যারোড্রোম সনদ দেয়, যা আন্তর্জাতিক ঘোষণার পূর্বশর্ত। কক্সবাজারে এসব সুবিধা নিশ্চিতের আগেই আন্তর্জাতিক ঘোষণা দেওয়া অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত।
জানা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার নিরাপত্তাবিষয়ক সব ইনফ্রাস্ট্রাকচার পুনর্মূল্যায়নে নেমেছে। এ প্রেক্ষাপটে কক্সবাজারের প্রস্তুতি ঘাটতি চোখে পড়ায় ঘোষণাটি স্থগিত করা হয়েছে। বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, কক্সবাজারের ফায়ার ফাইটিং রেসপন্স ইউনিট ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ এখনো সম্পূর্ণ নয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডে অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও নিরাপত্তা ঘাটতি স্পষ্ট হয়েছে। কক্সবাজারেও একই ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই যথাযথ নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত প্রস্তুতি ছাড়া অপারেশনাল ঝুঁকি না নিতে ঘোষণাটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অন্তত দুটি ফায়ার ফাইটিং যান থাকা বাধ্যতামূলক। কক্সবাজার বিমানবন্দরে ফোম, কমপ্লিমেন্টারি এজেন্ট এবং ২-৩ মিনিটের রেসপন্স টাইম নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া অ্যারাইভাল ও ডিপার্চার লাউঞ্জ, ডিপার্চার কনভেয়র বেল্ট এবং ইমিগ্রেশন কাউন্টারের কাজও এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। রানওয়ে প্রস্তুত থাকলেও ফায়ার ফাইটিং ইউনিট, রেসপন্স টিম, ওয়ার্কফোর্স ট্রেনিংসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনো অপ্রস্তুত।
বেবিচকের সদস্য ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন (এফএসআর) মুকিত উল আলম মিয়া যুগান্তরকে বলেন, আমরা অনেকগুলো লিমিটেশনসহ সার্টিফিকেশন করেছি। ওখানে একটি বোয়িং ৭৩৭ ল্যান্ডেড থাকলে অন্য আরেকটি প্লেন উড্ডয়ন বা অবতরণ করতে পারবে না। বোয়িং ৭৩৭ ধরনের বিমান পরিচালনার জন্য অন্তত ফায়ার ক্যাটাগরি ৭ প্রয়োজন। তবে কিছু ক্ষেত্রে ফ্রিকোয়েন্সি বা ফ্লাইট সংখ্যা বেশি হলে সেটি ক্যাটাগরি ৮-এ পর্যন্ত উন্নীত করতে হয়। আইকাও মানদণ্ড ৭-এর জন্য দুটি ফায়ার ফাইটিং গাড়ি থাকা বাধ্যতামূলক। সেখানে দুটি গাড়ি ছিল এবং সে অনুযায়ী সার্টিফিকেশন সম্পন্ন হয়েছে। সার্টিফিকেশনের পর কোনো গাড়ি অন্যত্র ব্যবহারের জন্য সরানো হয়েছে কিনা জানা নেই।
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক ঘোষণা দেওয়ার পর কিছু জটিলতা দেখা দেয়। ঘোষণার পর প্রশ্ন ওঠে কোনো নন-শিডিউল ফ্লাইট যদি সেখানে পরিচালিত হতে চায় অথবা আকাশে থাকা কোনো বিমান জরুরি অবতরণের প্রয়োজন হলে সেটি কক্সবাজারে নামতে পারবে কি না। যেহেতু বিমানবন্দরটির পূর্ণ সক্ষমতা এখনো অর্জিত হয়নি, তাই বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এ কারণেই ‘অপারেশন সাসপেন্ডেড’ নোটিশ জারি করা হয়েছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম যুগান্তরকে বলেন, যদি কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিতে হয়, তবে তা মাঝারি থেকে বৃহৎ আকারের বিমান (যেমন বোয়িং ৭৬৭ বা এয়ারবাস এ৩০০) পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হতে হবে, যার জন্য সাধারণত আইকাও ক্যাটাগরি ৭-এর ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করা আবশ্যক। তিনি প্রশ্ন তোলেন কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ করা হয়ছে। তাহলে আন্তর্জাতিক মান স্থগিত হল কেন?
এদিকে সরকার আন্তর্জাতিক ঘোষণা দেওয়ার আগে এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করেনি। যে কারণে বিমানবন্দরটিকে ‘আন্তর্জাতিক’ স্বীকৃতি দেওয়ার পরও কোনো দেশি বা বিদেশি এয়ারলাইন্স কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাজ্যগামী ফ্লাইট চালু থাকলেও কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনাকে লাভজনক মনে করছে না বিমান সংস্থাগুলো। এমনকি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যে এয়ার সার্ভিস অ্যাগ্রিমেন্ট রয়েছে, তাতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আন্তর্জাতিক ঘোষণার পরও কক্সবাজারের নাম যুক্ত হয়নি। বেবিচক থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস-বাংলা ও বিদেশি কয়েকটি কোম্পানিকে সম্ভাব্য রুট ও সময়সূচি দিতে চিঠি পাঠানো হলেও কেউ তাতে সাড়া দেয়নি।
কক্সবাজার বিমানবন্দরে কর্মরত প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এখনো আন্তর্জাতিক টার্মিনাল প্রস্তুত নয়। কনভেয়র বেল্ট বসানো হয়নি, লাইটিং, ফায়ার অ্যালার্ম, ফায়ার প্রটেকশন এবং ফায়ার পাম্পের কাজও বাকি। টার্মিনালের প্রবেশদ্বারের নির্মাণ চলছে, অভ্যন্তরের ফার্নিচার ও এফডিআইসংক্রান্ত কাজও অসম্পূর্ণ। রানওয়ের কাজ শেষ হয়নি, ওভারলে বাকি। লাগেজ স্ক্যানিং মেশিন ও মেটাল ডিটেক্টর এখনো আসেনি। এমনকি সাইনবোর্ডও স্থাপন করা হয়নি। এসব কাজ সম্পূর্ণ করতে আরও অন্তত ছয় মাস থেকে এক বছর লাগবে।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সফিউল আলম কাজল যুগান্তরকে বলেন, ১২ অক্টোবর কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণার পর আমরা অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত ছিলাম। পর্যটন ব্যবসায়ীরা আশাবাদী ছিলেন, এ ঘোষণার ফলে কক্সবাজারে পর্যটনের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। কিন্তু হঠাৎ করে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত আমাদের হতাশ করেছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সদস্য (এটিএম) নূর-ই-আলম যুগান্তরকে জানান, মন্ত্রণালয় থেকে কার্যক্রম স্থগিত করার নির্দেশনা পেয়েছেন। আপাতত সেখানে কোনো আন্তর্জাতিক শিডিউল ফ্লাইট নামবে না।