Image description
এনআরবিসি ব্যাংকের ৮ হাজার কোটি টাকা লুট : বিদেশে বসে ফের চক্রান্তে চক্রের সদস্যরা

রাশিয়া শাখা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এস এম পারভেজ তমাল। নিজের পরিচয় দিতেন শেখ সেলিমের পোষ্যপুত্র ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে। দলীয় আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ২০১৩ সালে লাইসেন্স নিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংকিং জগতে প্রবেশ করেন তমাল। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে বিভিন্ন সময়ে নানা কৌশলে ব্যাংকটি থেকে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। টর্চার সেলে নিয়ে বেদম মারধর-নির্যাতনের পর ব্যাংক থেকে পদত্যাগেও বাধ্য করা হতো। বর্তমানে তমাল পারভেজ চক্রের বিরুদ্ধে ঢাকা, বরিশাল, খুলনা ও সাতক্ষীরাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় হত্যা মামলার তদন্ত চলমান। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও তার বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তবে আসামিরা বিদেশে পলাতক থাকলেও তমাল চক্রের কালো ছায়া এখনো বিদ্যমান এনআরবিসি ব্যাংকে। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়ালেও তমালের কূটকৌশলে পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শেখ সেলিম, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসসহ পতিত আওয়ামী সরকারের একাধিক মন্ত্রী-এমপিদের ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বিশেষ সুবিধায় ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করেন পারভেজ তমাল। এ ছাড়া ঘুষের মাধ্যমে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা, উপশাখায় ছাত্রলীগের প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মীকে চাকরি দেন। শেখ সেলিম ও ফজলে নূর তাপসসহ প্রভাবশালী দু’জন সাবেক গভর্নরের হাত ধরে ২০১৭ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের পদটি বাগিয়ে নেন তমাল। এরপর এনআরবিসি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থ লোপাটের বেশ কয়েকটি অভিযোগপত্র বা তথ্য-উপাত্ত এসেছে নয়া দিগন্তের হাতে। সেসব নথিপত্র অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হলেও ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল ও পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামসহ বিতর্কিত পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় শেখ হাসিনা আমলের অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক।

 

অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকটিতে চরম অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার নজির স্থাপনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ছিলেন সদ্য সাবেক কর্তৃত্ববাদী চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল, এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমাম ও তাদের সব অপকর্মের দোসর পালের গোদা ডিএমডি হারুনুর রশিদ। ধারাবাহিকভাবে ১৩ বছর ধরে ব্যাংকের সব খাতে দুর্নীতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক এই হারুন। ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সময়ে দাখিলকৃত অভিযোগ থেকে দেখা যায়, ব্যাংক লুটের নিখুঁত পরিচালনাকারী হিসেবে এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ঢাকার বসুন্ধরা, বারিধারা, পূর্বাচল, শান্তিনগর, ধানমন্ডি, গাজীপুর, সাভার, হেমায়েতপুর, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ২৭টি প্লট এবং অসংখ্য ফ্ল্যাটের মালিক। ব্যাংকটির শুরু থেকেই তৌফিক-ফারাসাত ও তমাল-আদনানের সব কুকর্মের মূল কুশীলব, আবার ব্যাংকটির অভ্যন্তরে সঙ্ঘবদ্ধ দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটেরও প্রধান পুরোধা সে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর এড়িয়ে উপশাখার অনুমোদনের অপব্যবহার করে অবৈধ পার্টনারশিপ ব্যাংকিং এসকেএস প্রকল্পের মাধ্যমে টাকা লোপাটের মূল কর্মকর্তা, এসকেএস প্রকল্পের প্রধান বিজনেস ও ঋণ অনুমোদনকারী কর্মকর্তাও তিনি, যা কি না সুস্পষ্ট ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’। এসকেএস প্রকল্পের দালাল জনির সাথে মিলে তমাল ও রাসেল আহমেদ লিটনের সাথে যোগসূত্র স্থাপনকারীও তিনি। ব্যাংকের সূত্র মোতাবেক এসকেএস ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের নামে ব্যাংকের প্রায় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা লুট হলেও এখান থেকে ডিএমডি হারুনুর রশিদ, রমজান আলী ও সাফায়েত কবির কানন চক্র কয়েক শ’ কোটি টাকা হাতিয়েছেন। এ ছাড়া হারুনের ভায়রা আলমাস সর্দারের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে, অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসা ও আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে ব্যাংকের লুণ্ঠিত কয়েক শ’ কোটি টাকা পাচার করেছে। ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সময়ে দাখিলকৃত অভিযোগ থেকে এসব জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের বিভিন্ন সময়ে করা পরিদর্শন ও বিশেষ তদন্ত রিপোর্টেও এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্র্ষদের সদস্য পারভেজ তমাল, আদনান ইমাম ও তৎকালীন ডিএমডি হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে এই সংঘবদ্ধ দুর্নীতিবাজ চক্রের নানাবিধ গুরুতর আর্থিক অপরাধ ও মানিলন্ডারিংয়ের সত্যতা পাওয়া গেছে। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো কার্যকরী ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি ব্যাংকটির পূর্ববর্তী কিংবা বর্তমান কোনো কর্তৃপক্ষই।

এই ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা পরিচালক যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী স্বনামধন্য হিসাববিদ সারোয়ার জামান চৌধুরী ২০২৪ সালের ১৩ জুন ব্যাংকের এজিএমে অংশগ্রহণ করলে তাকে পারভেজ তমাল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। তা ছাড়া ছাত্র-জনতা হত্যা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগকে ব্যাপক অর্থ সরবরাহ করার কারণে আলোচিত পারভেজ তমাল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ঢাকা, বরিশাল, খুলনা ও সাতক্ষীরাতে কয়েকটি হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও তার বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন।

এদিকে দানব তমাল ২০১৭ সালে ব্যাংক দখলের পর তার বন্ধু এনটিএমসির ডিজি জিয়াউল আহসানের মাধ্যমে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে ব্যাংক কার্যালয়েই গড়ে তোলেন আয়নাঘরের আদলে টর্চার সেল। যেখানে নিয়মিত পেশাদার কর্মকর্তাদের নির্যাতন করা হতো। এই সেলের প্রধান ছিলেন ব্যাংকের সিকিউরিটি ফোর্সের প্রধান কমান্ডার (অব:) ফরহাদ সরকার আর তার সহযোগীরা হলেন পারভেজ হাসান, দিদারুল হক মিয়া, আহসান হাবিব, জাফর ইকবাল হাওলাদার, জমির উদ্দিন, কামরুল হাসান, আসিফ ইকবাল, ক্যাপ্টেন মেহমুদ অভি, ইয়াসিন আলী ও পারভেজ তমালের ব্যক্তিগত গানম্যান কালামসহ প্রায় ২৫ জনের একটি টিম। এরা ছাত্রলীগ ও বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয় করেই তাদের কার্য পরিচালনা করত। টর্চার সেলের পাশাপাশি এই টিম পারভেজ তমালের হয়ে জায়গা-জমি, গাড়ি-বাড়ি-স্থাপনা দখল, তমালের বন্ধু শফিকুল আলম মিথুনের নামে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে আনা, সরকারি দফতর নিয়ন্ত্রণ, এনআইডি কার্ডের তথ্য চুরি ও বিদেশী কোম্পানির কাছে পাচার, বিআরটিএ, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সরকারি জায়গা কব্জা করা, সচিবালয় নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকের সব কেনা-কাটায় অনিয়মের সাথে জড়িত ছিল। এ ছাড়াও দুর্নীতিলব্ধ অর্থ পাচার, বৈদেশিক মুদ্রার অর্থ দিয়ে নয়ছয় করে চোরাকারবারি ব্যবসা পরিচালনা, দুর্নীতিলব্ধ অর্থ দিয়ে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে নিজ ব্যাংকের সাথে ব্যবসা পরিচালনা, নিয়োগ বাণিজ্য ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, বহিষ্কৃৃত যুবলীগ নেতা ক্যাসিনো কাওসার মোল্লা ও আল নাহিয়ান খান জয়ের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিপত্য বিস্তার- নানা জঘন্য কর্মকাণ্ডের সাথে তমাল চক্রের এই ২৫ জনের টিম সংশ্লিষ্ট ছিল। আর এসব অপকর্মের মূল পরিচালনাকারী হলেন ব্যাংকের পক্ষ থেকে কমান্ডার (অব:) ফরহাদ সরকার (এনটিএমসি’র জিয়াউল আহসান মনোনীত), সাথে ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, ছাত্রলীগের নেত্রী তিলোত্তমা সিকদার ও আতিকা, শেখ হাসিনার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি তুষার এবং ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা জুয়েল হোসেন শ্রাবণ (কয়েক ডজন খুনের মামলারও আসামি)।

অভিযোগ রয়েছে, বরিশালের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি মারিয়া আক্তারের নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় একটি ব্র্যান্ড-নিউ পাজেরো গাড়ি আমদানি করে সেই গাড়িতে মন্ত্রী/এমপি’র স্টিকার লাগিয়ে প্রটোকল নিয়ে সারা দেশ দাপিয়ে বেড়াতো এই তমাল।

৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর এ পর্যন্ত তিনবার পারভেজ তমাল তার দুর্নীতিবাজ চক্রের মনোবল ঠিক রাখার জন্য সিন্ডিকেটের সদস্যদের অস্বাভাবিক পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি করেই যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২২ সাল থেকেই এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসলেও থামছে না তাদের এসব কর্মকাণ্ড। বিশেষ পদোন্নতি ও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যাদের বিরুদ্ধে আগেও আপত্তি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব কর্মকর্তাদের কেন বারবার অস্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় সে বিষয়ে। কিন্তু এসব বিষয়ে একেবারেই নীরব সুশাসনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পুনর্গঠিত ব্যাংকটির নতুন স্বাধীন ও স্বতন্ত্র পর্ষদ। তার এই দুর্নীতিবাজ চক্রের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের স্বপদে বহাল রেখেই তদন্ত প্রক্রিয়া ও ফরেনসিক অডিট পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে করে বিচার প্রক্রিয়া প্রভাবিত হচ্ছে ও প্রকৃত দোষীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনাটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

এসব অপকর্মের বিপরীতে অবস্থান নেয়া মাহফুজুল হক নামে একজন নির্ভীক কর্মকর্তার নাম নয়া দিগন্তের হাতে এসেছে। জানা গেছে, তমালের দুর্নীতিতে সহযোগিতা না করে বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ভূমিকা রাখায় দুর্নীতিবাজ চক্রের হাতে তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন। যার পাশে বাংলাদেশ ব্যাংকও সে সময় দাঁড়ায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং একমাত্র অটিস্টিক সন্তানকে নিয়ে বিগত আড়াই বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করলেও এখনো তাকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক বা এনআরবিসি কর্তৃপক্ষ নেয়নি। কারণ তমাল চক্রের অপসারণ হলেও ওই চক্রের দোসররা ঠিকই এখনো স্বপদেই বহাল।