Image description
৫ বছরে ১৩৬৯টি দুর্ঘটনায় নিহত ১৫২১ আহত ৭৬৩ জন

সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে অনুমতির বৈধতা এবং অবৈধতার মারপ্যাঁচে বন্দী থাকা লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে অরক্ষিত এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথ। দেশে অনুমোদিত রেলক্রসিংয়ের অর্ধেকেই নেই গেট কিপার। পাশাপাশি আছে অন্তত এক হাজার ২৩৫ স্পটে অবৈধ লেভেল ক্রসিং। রেল কর্তৃপক্ষের ভাষায়, অনুমতি না নিয়ে বিভিন্ন বিভাগ এসব লেভেল ক্রসিং তৈরি করেছে। বৈধ-অবৈধ এসব ক্রসিংয়ে গেট ও গেটম্যান না থাকায় ট্রেনের হুইসেলই ভরসা। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে বড়-ছোট দুর্ঘটনা। জীবনহানি ছাড়াও মালামাল ধ্বংসের পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে ট্রেনের মূল্যবান সম্পদও। এ দিকে রেলওয়ের সাথে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণেই অবৈধ লেভেল ক্রসিং বাড়ছে বলে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের পরামর্শ, বৈধ-অবৈধতার ম্যারপ্যাঁচ নয়, সড়ক নির্মাণ যারাই করুক না কেন ক্রসিংয়ে গেটম্যান ও গেট নির্মাণের দায়িত্ব নিতে হবে রেল কর্তৃপক্ষকেই।

সূত্র মতে, সারা দেশে ৪৪টি জেলায় দুই হাজার ৯৫৫ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার রেলওয়ে রুট আছে। সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্য মতে এই বিশাল পথে লেভেলক্রসিং আছে তিন হাজার ১১৬টি। এর মধ্যে এক হাজার ৮৮১টি অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৯৪৩টিতে গেটকিপার থাকলেও নেই ৯৩৮টিতে। বাকি এক হাজার ২৩৫টি লেভেল ক্রসিংয়ের কোনো অনুমোদনও নেই। গেটকিপারও নেই। অর্থাৎ অনুমোদিত এবং অননুমোদিত মিলে দুই হাজার ১৭৩টিতে গেটম্যান নেই।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্র জানায়, রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগ নিয়ে গঠিত পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে বৈধ এক হাজার ৩৪টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৭১৫টিতেই নেই গেটম্যান। মাত্র ৩১৯টিতে গেটম্যান থাকলেও দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে অনুমোদন থাকা ৭১৫টি লেভেল ক্রসিং গেটম্যান ছাড়া চলছে। এগুলোর সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড থাকলেও অবৈধভাবে গড়ে উঠা ৩৩৯টি ক্রসিংয়ের সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ডও নেই।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেল কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করেই সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ বিভিন্ন সময়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করতে গিয়ে এসব লেভেল ক্রসিং সৃষ্টি করেছে। আইন অনুযায়ী এসব ক্রসিংয়ের গেট ও গেটম্যান থেকে শুরু করে সব ব্যয়ভার ও দুর্ঘটনার দায় রেলওয়ের। সূত্র মতে অবৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ৭০ ভাগই হলো এলজিইডি, সওজ বিভাগ ও জেলা পরিষদের সৃষ্টি। এ ছাড়াও রেললাইনের পাশে নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণের কারণেও অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা বাড়ছে। রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করতে হলে রেলওয়ের অনুমোদন নেয়ার বিধান থাকলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সেই অনুমোদনের তোয়াক্কা করে না।

রেলওয়ের নথিপত্র ঘেটে দেখা যায়, বিভিন্ন সরকারি সংস্থাই অননুমোদিত এসব লেভেলক্রসিং নির্মাণে জড়িত। অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে যেমন গেটকিপার নেই, নেই কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও। বেশির ভাগ সরকারি সংস্থা সড়ক নির্মাণের সময় তাদের অনুমতি নেয়নি। তবে রেলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নির্মাণ করা বৈধ রেলক্রসিংয়ের ৬১ দশমিক ৫৮ শতাংশও আছে অরক্ষিত।

যাত্রীসেবা ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৩৬৯টি রেলওয়ে দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫২১ জন নিহত এবং ৭৬৩ জন আহত হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালে ১০৮টি দুর্ঘটনায় নিহত ২২৮ জন এবং আহত ৫৪ জন। ২০২১ সালে ১২৩টি দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত এবং ৩৯ জন আহত হয়েছে। ২০২২ সালে ৩৫৪টি দুর্ঘটনায় ৩২৬ জন নিহত এবং ১১৩ জন আহত হয়েছে। ২০২৩ সালে ২৮৭টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩১৮ জন নিহত এবং ২৯৬ জন আহত এবং ২০২৪ সালে ৪৯৭টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত এবং ৩১৫ জন আহত হয়েছেন। যাত্রীসেবা ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্তরা জানিয়েছেন, হতাহতের প্রায় সবাই ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী। রেলক্রসিং পারাপারের সময় যেসব পথচারী প্রাণ হারান, সেই হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে না।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, রেলের এই দুর্ঘটনার প্রায় ৮০ শতাংশই ঘটছে চালক ও স্টেশন মাস্টারদের গাফিলতি এবং লাইনচ্যুতি ও লেভেল ক্রসিংয়ে। রেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া অন্তত সাড়ে তিন গুণ মানুষ ট্রেনের আরোহী নয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, তার ৮৯ শতাংশই ঘটে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে। কখনো বাসের সাথে, কখনো মাইক্রোবাসসহ অন্য যানবাহনের সাথে ট্রেনের সংঘর্ষে এসব প্রাণহানি ঘটে। অথচ এসব ক্রসিং নিরাপদ করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিককারে নেই।

এলজিইডি জানিয়েছে, রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং বৈধ-অবৈধ ধারণাটি ভুল। এ বিষয়ে অনেক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। সমাধানে আসা যায়নি। একের পর এক মানুষের প্রাণহানি বেদনাদায়ক। টাকা কে খরচ করবে? সবই তো সরকারি টাকা। মানুষের নিরাপত্তাই মূল। কারিগরি কিংবা যৌক্তিকতার কোনো বিবেচনাতেই লেভেল ক্রসিং এলজিইডি বা অন্য সংস্থার পক্ষে রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয়। এটা রেলওয়েকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

সুশাসনের জন্য নগারিক সুজনের রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু জানান, পাহারাদার ছাড়া কোনো লেভেল ক্রসিং রাখার অর্থই হলো, এখানে প্রাণ ঝরবে। এটা জেনেও যদি কেউ সুরক্ষার ব্যবস্থা না নেন, তাহলে তো বলতে হবে, মানুষের মৃত্যুতে তাদের মাথাব্যথা নেই। সড়ক ও রেল দু’টিই জনগণের জন্য এবং তাদের টাকায় নির্মাণ করা হয়। ফলে সুরক্ষা তাদের প্রাপ্য।

সমন্বয়হীনতায় বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ ক্রসিং : স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরসহ যে সংস্থাগুলো অবৈধ লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করেছে তাদের সাথে রেলওয়ের সমন্বয়হীনতায় পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।

রেলওয়ের ট্রাফিক ট্রান্সপোর্টেশন বিভাগ জানিয়েছে, রেলের জমির ওপর দিয়ে যারা রাস্তা নির্মাণ করেছে তাদেরকেই এই দায় নিতে হবে। রেল কারো জমি ব্যবহার করে না। যারা রেলের জমি ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণ করছে তাদের উচিত রেলওয়েকে অবহিত করা। তারা রেলকে অবহিত করলে গেটম্যান দেয়া, ব্যারিকেড স্থাপন করতে রেলওয়ের উদ্যোগ নেয়া সম্ভব।

সূত্র জানায়, এই সমন্বয়হীনতা রোধে ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেখানে স্থানীয় সরকার এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিকে রেলওয়েতে অরক্ষিত (রেল হেটবিহীন) বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা নির্ধারণসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই কমিটির কার্যক্রম চোখে পড়ে না। বরং কমিটি গঠনের পর দেশে আরো অবৈধ লেভেল ক্রসিংয় তৈরি হয়েছে। তবে রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের লিখিত নির্দেশনা না থাকায় অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মূলত কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। এতে লেভেল ক্রসিংগুলোয় দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, সড়কের সাথে রেলের কোনো সমন্বয় নেই। শুধু যে লেভেল ক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণ তা নয়। রেললাইনের আশপাশের এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। পাহারাদার ছাড়া কোনো লেভেল ক্রসিং রাখার কোনো সুযোগ নেই। রেললাইনের পাশে তিন ফুট করে খুঁটির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নগরায়নের জন্য রেললাইনের প্রতি কিলোমিটারের মধ্যে একটি করে লেভেল ক্রসিং তৈরি হয়ে গেছে।

উত্তরণে সমীক্ষা প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি নেই : এমন পরিস্থিতির উত্তরণের রেলওয়ে ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) দেশের দুই হাজার ৮৩টি লেভেলক্রসিংয়ে সমীক্ষা চালায়। যার মধ্যে এক হাজার ৮০টিই অননুমোদিত। যৌথ সমীক্ষা শেষে উত্তরণে নানা সুপারিশ দিয়েছে রেলওয়েকে। সমীক্ষায় নিযুক্ত থাকা সূত্র মতে, দেশের তিন হাজার ১১৬টি লেভেল ক্রসিংয়ের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশিকে অনিরাপদ দেখানো হয়েছে। সারা দেশের আরো দুই হাজার লেভেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তায় গেটম্যানসহ সুবিধা বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতে ৪৭টি লেভেলক্রসিংয়ে ওভারপাস বা আন্ডারপাস নির্মাণ এবং গেটম্যান না থাকা ১৯৪টি ক্রসিংয়ে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যাতে ট্রেন আসার সময় সতর্কতা ঘণ্টা বেজে ওঠে। এ ছাড়াও এক হাজার ৪৩৬টি ক্রসিংয়ে গেট ব্যারিয়ার ও বিদ্যুৎ-টেলিফোন লাইন স্থাপনসহ অন্যান্য মৌলিক সুবিধা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। ওই সমীক্ষায় স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত ৬৩টি ক্রসিং বন্ধ করার কথাও বলা হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে ক্রসিংগুলোতে পাঁচ হাজার ৭৭২ জনকে নিয়োগের সুপারিশও করা হয়েছে।

সমীক্ষা সূত্র জানায়, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের করা সমীক্ষায় উঠে এসেছে রেলপথের ভয়াবহ চিত্র। বর্তমানে দেশের ৪৪ জেলাকে ঘিরে রেলওয়ের যে রুট আছে তার মধ্যে ৩৯টি জেলার ওপর দিয়ে যাওয়া রেললাইনেই রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। রেলপথের মান নষ্ট হওয়া, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, মাটি সরে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে দেশের প্রায় অর্ধেক রেললাইন ঝুঁকিতে আছে।

রেলওয়ের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ২০২২ সালে সমীক্ষাটি ২০২৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে রেলওয়ের সদর দফতরে জমা দেয়া হয়। কিন্তু এই সমীক্ষা সুপারিশ বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না দীর্ঘ সময়েও।

এ ব্যাপারে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক ফরিদ আহমেদ জানান, ‘রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগ নিয়ে গঠিত আমাদের পশ্চিমাঞ্চলে জোনে অনুমোদিত লেভেল ক্রসিং রয়েছে এক হাজার ৩৪টি। এর মধ্যে ৩১৯টিতে গেটম্যান আছে। বাকিগুলোতে আপাতত গেটম্যান নেই। সেগুলোতে অস্থায়ী লোকবল নিয়োগ দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। আমরা আর কোনো সংস্থাকেই লেভেলক্রসিং দেয়ার অনুমতি দিচ্ছি না। যেসব অননুমোদিত লেভেলক্রসিং আছে সেগুলোরও বৈধতা দিচ্ছি না।

অন্যদিকে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক সুবক্তগীন জানান, পূর্বাঞ্চলে অনুমোদন পাওয়া ৪৪৯টি গেটম্যান নেই। অস্থায়ীভাবেই লোকবল দিয়ে গেট পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত গেটের সংখ্যা বাড়ছে। এলজিইডি, সওজ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া অননুমোদিত লেভেলক্রসিং নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ বিষয়ে প্রকল্প হাতে নিয়েছে রেলওয়ে। প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া দরকার।