Image description
দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা

জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ প্রণয়ন করা হলেও হঠাৎ এর পরিবর্তন ও  বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। দলটির পক্ষে বলা হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশন প্রতারণা করেছে। যে সনদের কথা বলে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে চূড়ান্ত সনদের মিল নেই।

 
এতে ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রেফারি হয়ে গোল দেওয়ার এক মহাবিতর্কিত নজির স্থাপন করেছে। মনে হচ্ছে ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং দু-তিনটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ।

 

বিএনপির এই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে একমত তাদের সমমনা দলসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল।

 
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয়

 

নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত সনদকে সমর্থন করে বলা হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠিক সময়ে না হলেও গণভোট আগে দিতে হবে। এনসিপির পক্ষে বলা হয়েছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া না দেখেই স্বাক্ষর করে বিএনপি ভুল করেছে। সার্বিক এই অবস্থায় অনেকের ধারণা, প্রস্তাবিত জুলাই সনদ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এই বিভাজন দেশে  দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃৃষ্টি করতে পারে।

 

 

গত ২৮ অক্টোবর বাস্তবায়ন সুপারিশসহ জুলাই সনদ-২০২৫ সরকারের কাছে হস্তান্তর করে ঐকমত্য কমিশন। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা চলমান। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে গণভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে সনদের নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি ও ভিন্নমত) বাদ দিয়ে গণভোটের প্রস্তাবে রীতিমতো ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এরপর আগামী সংসদকে সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন এবং ২৭০ দিন বা ৯ মাস সময় বেঁধে দেওয়া এবং সেই সময়ের মধ্যে সংসদ ব্যর্থ হলে সংস্কার প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত করার সুপারিশ নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে।

এ ছাড়া বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের আপত্তি উপেক্ষা করে গণভোটে জনগণের সম্মতি পাওয়া গেলে ভোটের সংখ্যানুপাতে ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষ গঠনেও সংকট তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এই পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, আমি আগেই বলেছিলাম, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আসবে। আমি এটিকে ঐকমত্য কমিশনের বদলে আংশিক ঐকমত্য কমিশন বলি। কারণ এ কমিশন দেশের সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়ার চেষ্টা করেনি। তার পরও মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে যে জুলাই সনদ জমা দিয়েছে, সেটা তো আংশিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতাও না। এতে বোঝাই যাচ্ছে, এতে এই কমিশন নিজেদের পূর্বপরিকল্পনা বাস্তাবায়ন করেছে। কারণ এই কমিশনের সহসভাপতি নিজেই বলেছিলেন যে সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে। বিএনপিকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে তারা এ কাজটি করেছে। বিএনপির উচিত প্রতারণার জন্য কমিশনের শাস্তি দাবি করা। এই কমিশন জুলাই সনদের নামে দেশে একটি ধূম্রজাল তৈরি করার অপচেষ্টা করছে। দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে জাতিকে বিরত রেখে ইচ্ছামতো ক্ষমতায় থেকে যাতে ক্ষমতা ভোগ করা যায় তার জন্যই কলকাঠি নাড়া হচ্ছে।

মির্জা ফখরুল বললেন, ঐকমত্য কমিশন প্রতারণা করেছে : ঐকমত্য কমিশন জনগণের সঙ্গে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, অবাক হয়ে আমরা লক্ষ করলাম, গতকাল (গত মঙ্গলবার) যখন ঐকমত্য কমিশন প্রতিবেদন প্রকাশ করল, নোট অব ডিসেন্টগুলো নেই! পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে, ইগনোর করা হয়েছে। এটা তো ঐকমত্য হতে পারে না। তাহলে ঐকমত্য কমিশনটা করা হয়েছিল কেন? এই ঐকমত্য কমিশন, এটা আমি বলব জনগণের সঙ্গে একটা প্রতারণা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও এটা প্রতারণা। অবিলম্বে এ বিষয়গুলো সংশোধন করতে হবে। অন্যথায় এটি ঐক্যের বিপরীতে যাবে।

গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিচার-সংস্কার-নির্বাচন, অন্তর্বর্তী আমলে বাংলাদেশ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, সত্যিকার অর্থে যেটুকু সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার সম্পন্ন করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিন। জনগণ সেই নির্বাচনের ফল মেনে নেবে। কিন্তু যদি সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়, তার দায়ভার প্রধান উপদেষ্টাকেই বহন করতে হবে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, একটা সত্যিকার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশের সংকটগুলোর সমাধান সম্ভব। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের যে পার্লামেন্ট গঠিত হবে, সেই পার্লামেন্টই সংবিধানের মধ্য দিয়ে সংস্কারের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে। আমরা সে কারণে ৫ আগস্টের পরই নির্বাচনের কথা বলেছিলাম। তখন অনেকে বলেছিলেন, বিএনপি ক্ষমতা চায় বলেই তাড়াহুড়া করছে। আজ প্রমাণিত হচ্ছে, নির্বাচন যত দেরি হচ্ছে, ততই সেই শক্তিগুলো শক্তিশালী হচ্ছে, যারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়।

মির্জা ফখরুল আরো বলেন, আমরা জাতি হিসেবে ঠিক কোথায় যেতে চাই সেটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছি কি না, সেটা এখন বড় প্রশ্ন। এত বড় একটা অভ্যুত্থান, এত ত্যাগ, এত প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত পরিবর্তন, আমরা কি সেটা জাতির কল্যাণে কাজে লাগাতে পারছি? দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখছি, যতই দিন যাচ্ছে আমরা ততই বিভক্ত হয়ে পড়ছি। বিভক্তির এ প্রক্রিয়া কারা করছে, কেন করছে এটা আমাদের বুঝতে হবে।

তিনি বলেন, আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবলভাবে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করে প্রতিপক্ষকে আঘাত করার প্রবণতা চলছে। অথচ এই সময়টা আমাদের ঐক্যের সময়। ন্যূনতম বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছে একটা জাতীয় পথনির্দেশ তৈরি করার সময় এটা। কিন্তু সেই জায়গায় বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে।

বিএনপি সংস্কার চায় নাএমন প্রচারণাকে মিথ্যা আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, বিএনপির জন্মই হয়েছে সংস্কারের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পর একদলীয় শাসনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল বিএনপি। অথচ কনসাসলি একটা প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছে যে বিএনপি সংস্কারবিরোধী। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

কমিশনের সুপারিশে জাতি বিভক্ত হবে : বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু কমিশন যেসব সুপারিশ দিয়েছে তাতে জাতি বিভক্ত হবে, ঐক্য হবে না। গতকাল বুধবার রাজধানীর গুলশানে হোটেল লেকশোরে বিএনপি আয়োজিত ফ্রম রুল বাই পাওয়ার টু রুল অব ল শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা (ঐকমত্য কমিশনের কাছে) পক্ষপাতমূলক আচরণ আশা করি না। গত ১৭ অক্টোবর পার্লামেন্টের সাউথ প্লাজায় ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যেটি স্বাক্ষরিত হয়েছে সেই দলিলটা ওখানে নেই। শুধু আছে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশ। ঐকমত্য হলো কিভাবে, নোট অব ডিসেন্ট কোথায় কোথায় আছে, সেগুলোর কোনো কিছুই সেখানে উল্লেখ নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, এত দিন আমরা মনে করতাম, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রেফারির ভূমিকা পালন করছে। কালকে যে সুপারিশ তারা সরকারের কাছে প্রদান করেছে, তার মধ্যে একজন স্বাক্ষরকারী প্রধান উপদেষ্টাও বটে, কমিশনের সভাপতি হিসেবে। সুতরাং সেটা একপক্ষে সরকারেরও একটা এন্ডর্সমেন্ট হয়। কিন্তু রেফারিকে আমরা কখনো গোল দিতে দেখিনি।

তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার সময় মনে হয়েছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরো দুই-তিনটি দল তারা বোধহয় একপক্ষ, আমি বিপক্ষেই খেলছিলাম। সে হিসেবে জাতির পক্ষেই আমরা দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়েছে, কিছু দলের প্রস্তাব এবং কমিশনের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা জাতির ওপর জবরদস্তি করে আরোপিত করা হচ্ছে।

গণভোট নিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ যেভাবে প্রণীত হয়েছে, সেই একটি প্রশ্নে গণভোট হতে পারে, একই দিনে হতে পারে। সেই গণভোট কেন একই দিনে হবে সেই যুক্তি আমরা দিয়েছিলাম। যাতে ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়ে। যেহেতু প্রার্থীরা ভোটারদের নিয়ে আসবে এবং একই দিনে একই খরচে একই আয়োজন হয়ে যাবে ছোট্ট একটা ব্যালটের মাধ্যমে। আমরা তখন সে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। দুই একটি দল বাদে বাকি সবাই সেই প্রস্তাবে একমত ছিল। তবে যেসব প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশন এবং দু-একটি দল দিয়েছিল গতকালকের (গত মঙ্গলবার) সুপারিশের মধ্যে শুধু সেই প্রস্তাবগুলোই আছে।

বিএনপির এই নেতার আরো অভিযোগ, উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্বাচন সংস্কারসংক্রান্ত কমিশনের একটি অনালোচিত প্রভিশন আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করে অর্ডিন্যান্স পাস হয়েছে। আগে জোটভুক্ত যেকোনো রাজনৈতিক দলের স্বাধীনতা ছিল জোটের প্রতীকে অথবা নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করার। কিন্তু হঠাৎ করে তারা একটা অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বলে দিল, জোটভুক্ত হলেও তাদের নিজস্ব প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে। এতে একটি রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

সংসদ নির্বাচন ঠিক সময়ে না হলেও আগে গণভোট চায় জামায়াত : জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ ও সংস্কার প্রশ্নে আলাদা করে গণভোট দিতে হবে। কোনো কারণে সঠিক সময়ে নির্বাচন (সংসদ নির্বাচন) না-ও হতে পারে। তখনো তো জুলাই সনদ পাস করতে হবে। জুলাই সনদ তো সংস্কার। সুতরাং দুটিকে একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া কোনোভাবে সঠিক মনে করি না; বরং এটা জুলাই সনদকে অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

গতকাল বুধবার সকালে মগবাজারে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কমনওয়েলথের ইলেকটোরাল সাপোর্ট শাখার একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, গণভোট হচ্ছে জুলাই সনদ ও সংস্কারের ব্যাপারে জনমত। আর জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে দেশীয় রাষ্ট্র ক্ষমতার নির্ণয়ক। দুটি নির্বাচনের চরিত্রই ভিন্ন। জুলাই সনদ জাতির জন্য পরিবর্তনের দলিল, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম পরিবর্তনের সূচনা, সংস্কার আগে কখনো হয়নি। সেটা অনুধাবন করে অনতিবিলম্বে তারিখ ঘোষণা করে দিলে গণভোটটা আলাদা করে হবে।

বিভিন্ন দলের অসন্তুষ্টি : বিল্পবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সংগঠক সাইফুল হক কালের কণ্ঠকে  বলেন, সনদ বাস্তবায়নের এমন প্রস্তাব আমাদের কাঙ্ক্ষিত ছিল না। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে তাদের কনস্টিটিউশন পাওয়ার বা গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা আমরা কেউ কেউ বলেছিলাম। তবে তারা ২৭০ দিনে কার্যকর করতে না পারলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হয়ে যাবেএমন প্রস্তাব পৃথিবীর কোনো দেশে আছে কি না জানা নেই। আমি মনে করি, এটি পরবর্তী সংসদের ওপরই ছেড়ে দিলে ভালো হতো। তিনি আরো বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের প্রস্তাব বেশির ভাগ দলেরই ছিল। সেখানে কমিশন তার আগেও গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছেএটা ঠিক করেনি।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে রাজনীতিবিদদের অতীতে কোনো ধারণা ছিল না। তার পরও আমরা এর কার্যক্রমে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করেছি। কমিশন সুপারিশ করেছে, ভালো কথা। কিন্তু অধ্যাদেশের যে কথা বলা হয়েছে, তা তো সংবিধানে নেই। তাই বিষয়টি পরবর্তী সংসদের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে। না হলে নতুন জটিলতা দেখা দেবে।

সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশকে একপেশে হিসেবে দেখছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন বলেন, ঐকমত্য কমিশনের ৯ মাসের কার্যক্রম পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়েছে। সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক যে আদেশের কথা বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আদালতে গেলে টিকবে না। কারণ একটি সংবিধান বিদ্যমান থাকতে এ ধরনের আদেশের বৈধতা নেই। তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কার পরিষদ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধান না করতে পারলে, প্যানেল ভেঙে দেওয়ার বিধান থাকা উচিত ছিল। আর ঐকমত্য না হওয়া বিষয়গুলো না রাখার সিদ্ধান্তও সঠিক হয়নি। এসব কারণে সনদ স্বাক্ষর করা না করা সমান।

জুলাই সনদের নামে এখন রাজনীতিতে বৈষম্য ও বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি এ ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও দায়ি করেন। তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নামে ড. ইউনূস তিনটি দলকে এ ক্যাটাগরিতে স্থাপন করে ছোট দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এনসিপির কয়েকজন ছাত্রনেতা ছাড়া পুরো ছাত্রসমাজকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে গণভোটের কথা বলা, জনগণকে ব্লাফ দেওয়া বা  আইওয়াশ করার জন্য কি না বোঝা যাচ্ছে না।

নির্বাচিত সরকার বৈধতা না দেওয়া পর্যন্ত জুলাই সনদ বৈধতা পাবে না বলে মনে করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, নোট অব ডিসেন্ট কেন জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তার ব্যাখ্যা দিতে হবে ঐকমত্য কমিশনকে। এভাবে যদি কারো ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কা তৈরি হবে। এখন জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আলাদা সময়ে করার পরিস্থিতি নেই; বিলম্ব হলে আরো ঘোলাটে অবস্থা তৈরি হবে। এ বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

বাসদের (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, আমরা প্রথম থেকেই সনদে নোট অব ডিসেন্টগুলো রাখার প্রস্তাব দিয়ে আসছি। কমিশন এত দিন এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু না বললেও এখন সুকৌশলে বাদ দিয়ে দিয়েছে। আর সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে কার্যকর করতে না পারলে সংস্কার প্রস্তাবগুলো সয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব এক ধরনের প্রহসন। এ অবস্থায় গণভোট প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে এবং রাজনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

এনসিপি বলেছে সনদে সই করে বিএনপি ভুল করেছে :  জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া না দেখে জুলাই সনদে সাইন করে বিএনপি ভুল করেছে। এখন অন্যের ওপর দোষ না চাপিয়ে নিজেদের ভুলের কাফফারা দিন। ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে যখন জুলাই সনদের ড্রাফট দেওয়া হবে, তা দেখেই আমরা স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেব।

গতকাল বুধবার রাজধানীর বাংলামোটরে অবস্থিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।

তিনি আরো বলেন, জুলাই সনদকে রাজনৈতিক সমঝোতার ফাঁকা বুলি মনে করছি না। সাধারণ কোনো দলিল হিসেবেও দেখি না। তাই এর আইনি ভিত্তি অবশ্যই থাকতে হবে। আমরা বলেছিলাম, সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া দেখেই সই করার বিষয়টি বিবেচনা করব। আইনি ভিত্তি সম্পন্ন আদেশের খসড়া সরকার গ্রহণ করলে সনদ স্বাক্ষরের বিষয়ে অগ্রগতি তৈরি হবে। সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। তিনি আরো বলেন, গণ-অভ্যুত্থানকে ভিত্তিমূল ধরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাইনে একটি আদেশ জারি করতে হবে। যে আদেশের অধীনে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। টাইম ফ্রেম নিয়ে আমরা নির্দিষ্ট কোনো অবস্থান নিচ্ছি না।