আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের একটানা শাসনামলে ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া পুলিশের কোনো কর্মকর্তার ভাগ্যে পদোন্নতি জোটেনি। পদোন্নতি পাওয়া দূরের কথা, অনেককে মিথ্যা কাল্পনিক অভিযোগ দিয়ে বছরের পর বছর ধরে চাকরির বাইরে রাখা, ওএসডি রাখা এবং যেখানে লঘুদণ্ডে দণ্ডিতদের পোস্টিং করা হয়, সেসব স্টেশনে ফেলে রাখা হয়। অনেক কর্মকর্তা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন। কেউ সম্মান রক্ষায় মিশনে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। ওই তালিকার কেউ মারাও গেছেন। এমন এক বাস্তবতায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে সবার সঙ্গে বঞ্চিত পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের মাঝেও আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ১৫, ১৬, ১৮ ও ২০তম ব্যাচের ১০১ জন বঞ্চিত কর্মকর্তার বেশির ভাগেরই এখনো মূল্যায়ন হয়নি। যে কারণে বাড়ছে ক্ষোভ। বঞ্চিতদের বক্তব্য হচ্ছে, মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও হাসিনার দলদাশ হতে না পারায় তাদের কপালে দুঃখ নেমে আসে।
সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা সরকার তার গদি টিকিয়ে রাখতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ১৫, ১৬ ও ১৮ ব্যাচের কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে ২০ ব্যাচের ১৬ জনকে ২০২২ সালে ডিআইজি হিসাবে পদোন্নতি দেয়। যে তালিকায় ডিবির হারুন কিংবা ডিএমপির বিপ্লব সরকারও ছিল।
একজন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমান। শেখ হাসিনা সরকারের অন্যায় আদেশ না মানার কারণে দুই দফা চাকরি হারান তিনি। একবার আদালতের নির্দেশে এবং আরেকবার সরকারের নির্বাহী আদেশে চাকরি ফিরে পেলেও বঞ্চনা পিছু ছাড়ছে না। আওয়ামী লীগের দুর্নীতি-দুঃশাসন, গুম-খুন ও নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় এসপি পদ থেকেই ২০২২ সালে দ্বিতীয় দফায় চাকরি হারান তিনি। বিসিএস ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা জিল্লুরের ব্যাচমেটরা অনেক আগেই অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতি পেলেও তিনি ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে এসপি থেকে সরাসরি ডিআইজি হয়েছেন। তার কয়েকজন ব্যাচমেট অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতি পান। দুবার দেওয়া পদোন্নতি তালিকায় তার নাম ওঠেনি।
কেবল ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমানই নন। তার মতো এমন বঞ্চিত আরও অনেকেই।
পুলিশের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজনকে কীভাবে এই বিভাগে দমিয়ে রাখা হয় তার কিছু বিবরণ পাওয়া গেছে। যেমন ২০তম ব্যাচের প্রথম হয়েছিলেন আশিক সাঈদ বিগত বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আশিকের ললাটে জুড়ে দেওয়া হয় জামায়াত-শিবির তকমা। বর্তমানে তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে এডিশনাল ডিআইজি হিসাবে সংযুক্ত আছেন বলে জানা যায়। একই ব্যাচের (২০তম বিসিএস) মেধাবী অফিসার আবদুল মাবুদকে (দুলাল) শেখ হাসিনা শাসনের সাড়ে ১৫ বছর ধরেই বঞ্চিত করে রাখা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০০৪ সালের দিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কুমিল্লায় সদর ইউনিয়নে এক সম্মেলনে যান। তখন ওই কুমিল্লায় এএসপি হিসাবে কর্মরত ছিলেন আবদুল মাবুদ। ফলে তারেক রহমান ওই এলাকায় গেলে তাকে পুলিশ প্রটোকল দেন এএসপি মাবুদ। ওই সময় কারও তোলা একটি ছবিতে তারেক রহমানের সঙ্গে এএসপি মাবুদকে দেখা গেছে-এমন অভিযোগ এনে তাকে পদোন্নতি থেকে বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত করা হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তাকে এডিশনাল এসপি থেকে এসপি ও এডিশনাল ডিআইজি করে ঢাকা রেঞ্জে পোস্টিং দেওয়া হয়। যদিও তার ব্যাচের ১৬ জন ২০২২ সালেই ডিআইজি হয়েছেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার এডিশনাল ডিআইজি জাহিদুল হাসানকে শেখ হাসিনা সরকার বঞ্চিত করে বিএনপি পরিবারের সন্তান দাবি করে। জাহিদুল হাসানের ভাই হাসিব লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ছিলেন। এ কারণে তার কপাল পোড়ে। এভাবেই চার ব্যাচের শতাধিক কর্মকর্তাকে তাদের ন্যায্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়।
সূত্র জানায়, ফ্যাসিবাদ আমলে যেমন বঞ্চিতদের সারি দীর্ঘ ছিল, এখনো যেন সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। সব পদেই বঞ্চিতদের লাইন থাকলেও অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজি পদে পদোন্নতির বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। চলতি বছরের ২৯ মে ২৯টি ডিআইজি পদে পদোন্নতির জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়। এই ২৯টি পদ শূন্য থাকলেও বঞ্চিতরা পাচ্ছেন না পদোন্নতি। এ ছাড়া বিসিএস ১৫তম ব্যাচ থেকে শুরু করে ১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের অনেকেই এখনো তাদের প্রাপ্য পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলেন, জনগণের পক্ষে থাকায় ফ্যাসিবাদ আমলে আমাদের পদোন্নতি হয়নি। ভেবেছিলাম, সরকার পরিবর্তন হলে আমাদের ভাগ্যের উন্নতি হবে। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সুরাহা হচ্ছে না। প্রতি সপ্তাহে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভা হলেও অজ্ঞাত কারণে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়টি সেখানে উঠছে না। সবশেষ গত ১৯ আগস্টের সভায় পুলিশের পদোন্নতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এরপর আর কোনো আলোচনা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অজ্ঞাত কারণে অতিরিক্ত আইজিপি এবং ডিআইজি পদে বেশ কিছু পদ খালি থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। গত ১৯ মে ১২ জন ডিআইজিকে অতিরিক্ত আইজি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তখনই অতিরিক্ত ডিআইজিদের ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেওয়া যেত। কিন্তু এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এতে পুলিশের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। ১৫, ১৭, ১৮ এবং ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে যারা এখনো ডিআইজি হতে পারেনি তাদের মধ্যে হতাশা বেশি।
আওয়ামী লীগ আমলে ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তারা ডিআইজি ও ১৭তম ব্যাচর কর্মকর্তারা অতিরিক্ত আইজিপিও হয়েছিলেন। অথচ বৈষম্যবিরোধী সরকারের আমলে ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও ডিআইজি হতে পারছেন না। বিষয়টিকে দুঃখজনক উল্লেখ করে বঞ্চিত এক কর্মকর্তা বলেন, সহসাই পদোন্নতিজট না খুললে বিষয়টি আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি বলেন, বছরের পর বছর আটকে আছে আমাদের পদোন্নতির বিষয়টি। সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও কেন আমাদের পদোন্নতি হয়নি-বিষয়টি আওয়ামী লীগ আমলের দায়িত্বশীলদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তখন বলা হতো, গোয়েন্দা প্রতিবেদন নেগেটিভ। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলের গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন তো তা নয়। অনেক আগেই ইতিবাচক প্রতিবেদন জমা পড়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। সেখানে চাপা পড়ে আছে ফাইল। এ বিষয়টি মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। পুলিশকে গতিশীল করতে ফাইলগুলো দ্রুত সচল করা প্রয়োজন।
পদ ফাঁকা থাকার পরও কেন অতিরিক্ত আইজি এবং ডিআইজি পদে পদোন্নতি হচ্ছে না-এ বিষয়ে জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং আইজিপিকে একাধিকবার ফোন করা হলেও ফোন না ধরায় তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) একেএম আওলাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত আইজি পদে একটি এবং ডিআইজি পদে ৩২-৩৩টি পদ ফাঁকা আছে। তিনি বলেন, অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতির বিষয়টি এখন বলতে পারছি না। তবে ডিআইজির পদোন্নতির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।