প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে আবারও নভেম্বরে গণভোট এবং এখনই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে জুলাই সনদে সই করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা আহ্বান জানিয়েছে উল্লেখ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) বলেছে, জুলাই জাতীয় সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেই প্রক্রিয়া নিশ্চিত হওয়ার পর এনসিপি সনদে সই করবে।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন যমুনায় পৃথক বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির নেতারা এসব কথা বলেন। দুদলের পক্ষ থেকেই জানানো হয়, একটা আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা তাদের জানিয়েছেন। প্রথমে এনসিপির প্রতিনিধিদল এবং পরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।
এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। উল্লেখ্য, গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর থেকে তা বাস্তবায়নের পথ নিয়ে দলগুলোর অবস্থান ভিন্নতার প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন।
এখন প্রয়োজন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি- জামায়াত ॥ বৈঠক শেষে ব্রিফিংকালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, বিশেষ আদেশে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায় জামায়াত। আইনের কোনো ব্যত্যয় না থাকলে এ বিষয়ে আমরা সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার আদেশের কথা বলেছি। যার মাধ্যমে নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়গুলো পাস করিয়ে তার ভিত্তিতে হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টি দেখবেন বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। তবে আমরা কোনোভাবেই এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির আদেশের পক্ষে নই। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে বহু দলের পরিশ্রমে আমরা যে ঐকমত্যে পৌঁছেছি তাতে অনেকে সই করেছে। এখন প্রয়োজন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি।
বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মা’ছুম, রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা এসেছিলাম প্রধান উপদেষ্টাকে কিছু বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। সরকারের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করতে। আমরা দীর্ঘ আলোচনার পর সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে একটি সনদ স্বাক্ষর করতে পেরেছি, এ কারণে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।
তিনি বলেন, দীর্ঘ আলোচনার পর ৮০টির বেশি বিষয়ে একমত হয়েছি এবং সেইসব বিষয়কে দ্রুত আইনি ভিত্তি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে বিষয়গুলো প্রয়োজন, সেগুলোকে দ্রুত বাস্তবায়নের ঘোষণা দাবি করেছি। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন, এগুলো বাস্তবায়ন না হলে এই আলোচনার কোনো অর্থ থাকে না।
জামায়াতের এই সিনিয়র নেতা বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে আদেশ কে দেবেন এটা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। আমরা চাই এটা প্রধান উপদেষ্টা দেবেন। আইনগত ব্যত্যয় না ঘটলে প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে জুলাই সনদের আইনের ভিত্তি ঘোষণা দিতে পারেন। তিনি আরও বলেন, গণভোটের ব্যাপারে বলেছি। বিএনপিও গণভোটে রাজি হয়েছে। তবে বিএনপি জটিলতা তৈরি করেছে। তারা চাচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হোক। কিন্ত গণভোট হলো সংস্কারের সঙ্গে জড়িত, এটাকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে মেলানো যাবে না।
জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, বিএনপি অজুহাত দেখাচ্ছে গণভোটের সময় নেই। কিন্ত গণভোটের যথেষ্ট সময় আছে। নভেম্বরেই সেটা করা যাবে। এই গণভোট হলেই তাহলে জনগণের সিদ্ধান্ত নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন হবে, নয়তো আগের মতোই হবে।
আব্দুল্লাহ তাহের বলেন, আমরা উপদেষ্টাকে জানিয়েছি, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে এই পরিশ্রম প-শ্রম হবে। ড.ইউনূস এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। একটা আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, আদেশের মাধ্যমে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে হবে। এটা সংবিধানের অংশ নয়, তবে এ রকম পরিস্থিতিতে সরকারপ্রধান আদেশ দিতে পারেন। আশা করি তিনি এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন। আমরা বলেছি, গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন দুটো ভিন্ন ভিন্ন জিনিস আলাদা সময়ে হতে হবে। গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলে নির্বাচনের অনেক বিষয়ে পরিবর্তন হবে। সে কারণে আগে অবশ্যই গণভোট হতে হবে।
ডা. মোহাম্মদ তাহের বলেন, নোট অব ডিসেন্ট সংস্কারের কোনো আলোচনা হতে পারে না। নির্বাচন কমিশন, সচিবালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ একটি দলের। পুলিশ প্রশাসনেরও একই অবস্থা। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বলেছি নির্বাচনের আগে যেখানে যেখানে রদবদল করা প্রয়োজন, সেটি করুন। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করার জন্য প্রশাসনকে নিরপেক্ষ হতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে লটারির মাধ্যমেও করতে পারেন।
তিনি বলেন, নোয়াখালীতে ছাত্রশিবিরের কুরআন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে বিএনপির হামলার বিষয়টি আমরা প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আমরা বলেছি, নির্বাচনের আগেই যদি এ রকম পরিস্থিতি হয় তাহলে নির্বাচনের সময় কী হবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে কোনো আলোচনা করেনি উল্লেখ করে ডা. তাহের বলেন, কারণ বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আমরা মনে করি, এই বিষয়ে এখন কথা বলাটা ইম্যাচিউর্ড।
জামায়াতের নায়েবে আমির আরও বলেন, আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) পাশে কিছু লোক আপনাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে, কারণ তারা একটি দলের পক্ষে কাজ করছে। এজন্য তাকে সতর্ক থাকার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আমরা প্রথমে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, সেটাতেও যদি কাজ না হয় পরবর্তীতে যা যা করণীয় তাই করব।
বাস্তবায়ন পদ্ধতি দেখেই সনদে সই- এনসিপি ॥ জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের জুলাই সনদে সই করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং এনসিপির বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন বলে জানিয়েছেন। প্রতীক না থাকলে আমরা কী নিয়ে নির্বাচন করব? আর জুলাই জাতীয় সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেই প্রক্রিয়া নিশ্চিত হওয়ার পর তার দল সনদে সই করবে।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন নাহিদ ইসলাম। নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে দলটির অন্য নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ।
বৈঠক শেষে নাহিদ ইসলাম বলেন, গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হলে পরবর্তী সংসদের একটি গাঠনিক কাঠামো থাকবে। সেই কাঠামোয় একটি সংবিধান তৈরি করবে। এই পুরা প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ দেবে। তারপর সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটার ওপর নির্ভর করে আমরা জুলাই সদনে সই করার বিষয়টি বিবেচনা করার। এটা সরকারের কাছে আমরা দাবি জানিয়েছি এবং এই দাবিগুলো যেন বিবেচনা করা হয়। আর সরকার যেন সেই পথে যৌক্তিকভাবে এই জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আগায়, যে বিষয়ে জোর দাবি জানিয়েছি।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, ‘আমরা জানতে চেয়েছিলাম। আইন উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন যে, সরকার যেন তত্ত্বাবধায়কের মতো আচরণ করে অর্থাৎ নিরপেক্ষ আচরণ করে সে বিষয়ে বলা হয়েছে। তত্ত্বাবধয়ক সরকারের বিষয়টা জুলাই সনদের আওতাধীন। গণভোটের পরেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
এনসিপির আহ্বায়ক আরও বলেন, দ্বিতীয়ত আমরা নির্বাচন কমিশনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া, কমিশনের বর্তমান আচরণ আমাদের কাছে মনে হচ্ছে এটা নিরপক্ষ হচ্ছে না। এটা স্বচ্ছ হচ্ছে না এবং নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেভাবে কার্যক্রম করার কথা ছিল, সেটা করছে না। কিছু কিছু দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে এবং কোনো দলের প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণ করছে। তিনি বলেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে দায় সরকারের ওপর আসবে। তাই এ বিষয়ে সরকারকে আমরা বলেছি। আমরা মনে করি এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রয়োজন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে আমরা অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জুলাই গণহত্যার বিচারের বিষয়টি। আমরা আজকে দেখেছি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং অভিযোগের কারণে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে আদালতে আনা হয়েছে। আমরা এটাকে সাধুবাদ জানিয়েছি। সরকার এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি আমরা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। ন্যায়বিচারের একটি ধাপ আমরা আগাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, এর পাশাপাশি সারাদেশে শহীদ এবং আহত পরিবারের পক্ষ থেকে যেসব মামলা হয়েছে, সেই মামলাগুলোর বিষয়ে সরকারের কি পদক্ষেপ। পত্র পত্রিকায় আমরা দেখতে পাচ্ছি জামিনে আসামিরা ছাড়া পাচ্ছে। শহীদ পরিবার এবং আহতদের হুমকি দিচ্ছে। শহীদ পরিবার, আহতদের নিরাপত্তা এবং বিচারের যে রোডম্যাপ আমরা চেয়েছি সেই রোডম্যাপ যেন প্রকাশ করা হয়। ৮০০ এর অধিক যে মামলাগুলো হয়েছে সে মামলাগুলোর এখন কি অবস্থা, সেগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে, কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা জুলাই সনদ নিয়ে কথা বলেছি। জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে এবং এনসিপি সেখানে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে আমরা আমাদের অবস্থান সরকারের কাছে তুলে ধরেছি। ঐকমত্য কমিশনের কাছেও আমরা তুলে ধরেছি। আমরা সেই কথাগুলোই পুনর্ব্যক্ত করেছি যে, জুলাই সনদের শুধু কাগুজে মূল্যে আমরা বিশ্বাসী নই। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সেটির নিশ্চয়তা পাওয়ার পরেই আমরা সনদে স্বাক্ষর করবো।