Image description

ইচ্ছা ছিল চাকরি শেষে হজে যাবো। ২০২৩ সালে অবসরে গেছি। এখনো অবসরের টাকা পাই নাই। আমার নানান সমস্যা। কিছুদিন আগে ওপেন হার্ট সার্জারি করিয়েছি। পায়ের একটা আঙ্গুলে পচন ধরেছে, কেটে ফেলতে হয়েছে। এত চিকিৎসা করছি টাকা  পাবো কই? ওপেন হার্ট সার্জারির সময় একটা জমি বিক্রি করতে হয়েছে। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন মো. আশরাফুল ইসলাম। প্রাক্তন এই সহকারী অধ্যাপকের বাড়ি রংপুর জেলার মিঠাপুকার উপজেলায়। আশরাফুলের মতো প্রায় ৮৮ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। তারা চাকরি শেষ হলেও পাচ্ছেন না অবসর ও কল্যাণ সুবিধা।

প্রায় চার বছর ধরে শিক্ষকরা ঘুরলেও মিলছে না অবসরকালীন অর্থ। ২০২১ সালের পর থেকে অবসরে যাওয়া প্রায় ৮৮ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন এই তালিকায়। অর্থ না মেলার প্রধান কারণ আওয়ামী আমলের প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার নয়ছয়। যার মধ্যে ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকেই উধাও হয়ে যায়। বিপুল পরিমাণ এই শিক্ষকদের অবসরকালীন সুবিধা দিতে প্রয়োজন প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তাদের কাছে নেই এই পরিমাণ বিপুল অর্থ। অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষকদের জন্য গত জুন/জুলাইয়ে বরাদ্দ দেয় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

শিক্ষক-কর্মচারীদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য আদেশ দেন হাইকোর্ট। গত ২রা সেপ্টেম্বর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত ৬ লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারীকে অবসরের ছয় মাসের মধ্যে অবসরকালীন সুবিধা প্রদানের নির্দেশনা দিয়ে রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চের ১৩ পৃষ্ঠার এ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, অর্থ সংকটের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

১৯৯০ সালে এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণ ট্রাস্টের সুবিধা দেয়া হয়। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে অবসর সুবিধা। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ভবনে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয়। কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ আমলের প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার ও বন্ডের কোনো হিসাব নাই। এই অর্থ রাখা হতো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে। টাকার সংকটে থাকা ব্যাংকটি আওয়ামী সরকারের পতনের পর নিষ্পত্তি হওয়া ৩১ কোটি টাকা দিতেও অপারগতা প্রকাশ করে। এ ছাড়াও সমস্যা রয়েছে প্রতি মাসের চাহিদায়। বোর্ডের প্রয়োজন মাসিক ৬৫ কোটি টাকা। তহবিলে জমা হয় মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। প্রতি মাসে ঘাটতি হয় ১০ কোটি টাকা।

অবসর সুবিধা হিসেবে একজন শিক্ষক পান প্রায় ১২ লাখ টাকা এবং একজন কর্মচারী ৬ লাখ টাকা। কলেজের অধ্যক্ষ প্রায় ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পান। এতে অবসর বোর্ডে বছরে প্রয়োজন হয় ১ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। কিন্তু আয় হয় ৮৭৬ কোটি টাকা, ঘাটতি ৫০৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে কল্যাণ ট্রাস্টে শিক্ষকরা গড়ে সাড়ে আট লাখ টাকা পান। প্রতি মাসে আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ৬৫ কোটি টাকা। এমপিওর ৪ শতাংশ হারে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে আয় আসে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এফডিআরের লভ্যাংশ থেকে আয় হয় ২ কোটি টাকা। প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে ১৩ কোটি টাকা।

গত ৩রা মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভা শেষে রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য জমানো ৬ হাজার কোটি টাকা যে ব্যাংকে রাখা হয়েছিল, সেটি দেউলিয়া হওয়ায় শিক্ষকদের সঞ্চয়ের কোনো টাকা এখন আর নেই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, এই অর্থের সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের মাধ্যমে এই অর্থ লোপাট হওয়ায় সুবিধা করা যাচ্ছে না। আমরা চাইলেও কিছু করতে পারছি না। তাই আমরা ধীরে চলো নীতিতে অগ্রসর হচ্ছি। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা কনসার্ন। শিক্ষকদের ভোগান্তি লাঘবে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছি।