
জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তিন রাজনৈতিক দল। এ ছাড়া অন্যান্য দলের পক্ষ থেকেও এই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এর আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেয়া কয়েকটি দলও এমন প্রশ্ন তুলে সরকারকে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের তাগিদ দেয়। মঙ্গলবার চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি’র একটি প্রতিনিধিদল। বৈঠকে দলটির পক্ষ থেকে প্রশাসনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে প্রধান উপদেষ্টাকে তাগিদ দেয়া হয়। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত সাংবাদিকদের আলোচনার বিষয় অবহিত করেন। সরকারের কোনো দলীয় ব্যক্তি থাকলে তাদের অপসারণের দাবি জানানো হয় বলে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল।
প্রশাসনের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, সেক্রেটারিয়েটে যারা এখনো আছেন, যাদের চিহ্নিত ফ্যাসিস্টের দোসর বলা হয়- তাদেরকে সরিয়ে সেখানে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা দেয়ার জন্য আমরা বলেছি। আমরা বলেছি যে, প্রশাসনেও জেলা প্রশাসন বিশেষ করে সেখানেও একইভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমরা কিছু কিছু কথা বলে এসেছি, যেগুলো আমরা মনে করেছি যে- তারা এখনো সেই পুরনো সরকারের স্বার্থ পূরণ করছে, তাদের অপসারণের কথা আমরা বলেছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা সেইসঙ্গে পুলিশের নিয়োগের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে নতুন করে যে নিয়োগ দেয়া হবে বা পদোন্নতি দেয়া হবে, সেই ক্ষেত্রে একদম নিরপেক্ষ অবস্থা নেয়ার কথা আমরা বলেছি। আমরা বলে এসেছি যে, বিচার বিভাগে বিশেষ করে হায়ার জুডিশিয়ারিতে এখনো যে সমস্ত ফ্যাসিস্টদের দোসর আছেন, তাদের সরিয়ে সেখানে নিরপেক্ষ বিচারকদের দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও এটা জুডিশিয়ারি ব্যাপার। তারপরও প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু সবকিছুর দায়িত্বে আছেন, তার কাছে আমরা আমাদের সেই কনসার্নগুলো জানিয়ে এসেছি। সরকারকে সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য সরকারের মধ্যে যদি কোনো দলীয় লোক থেকে থাকেন, তাকে অপসারণ করার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি।
ওদিকে বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিতর্কিত কোনো কর্মকর্তা, বিশেষ করে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ শাসনামলে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কর্মকর্তাদের নির্বাচনে দায়িত্ব পালন থেকে নিবৃত রাখার জন্য প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি’র নেতারা। নির্বাচনের আগে প্রশাসনে রদবদলে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তারা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি’র নেতাদের জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচনের আগে প্রশাসনের যাবতীয় রদবদল সরাসরি তার তত্ত্বাবধানে হবে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগের জন্য একাধিক ‘ফিট লিস্ট’ থেকে যোগ্য কর্মকর্তাদের বাছাই করে প্রত্যেককে নির্বাচনের আগে যথাযোগ্য স্থানে নিয়োগ দেয়া হবে।
সর্বশেষ গতকাল জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে। এই বৈঠকে তারা প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
বৈঠকের পর জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশন, সচিবালয়ে, পুলিশ প্রশাসনে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ অফিসারই একটি দলের আনুগত্য করছে। আমরা গেলে তারা বলে প্রচণ্ড চাপ। এই যে চাপ, এই চাপ একটি দলের পক্ষ থেকে দেয়া হয়। প্রসিকিউটর যারা হয়, পিপি, এপিপি যারা হয় তাদের আশি ভাগই একটি বিশেষ দলের, কেউ কেউ বলেন, এটি আশি না ৬৫। এই ৬৫টিই যদি হয় তাতো অনেক বেশি হয়ে গেল। বাকি বাংলাদেশ ৩৫।
তাই আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলেছি নির্বাচনের আগে যেখানে যেখানে রদবদল করা প্রয়োজন, সেটি করুন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে লটারি করা যেতে পারে। তবে লটারির পেছনে যেন কোনো ভূত দাঁড়িয়ে না থাকতে পারে। তিনি বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করার জন্য প্রশাসনকে নিরপেক্ষ হতে হবে।
একইদিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা যে আচরণ করছে, তাতে নিরপেক্ষতা পাওয়া যাচ্ছে না। কমিশন পুনর্গঠন করা এখন সময়ের দাবি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রতীক না থাকলে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব নয়। শাপলা প্রতীক না পেলে আমরা অন্য কোনো প্রতীক নেবো না। যে নির্বাচন কমিশন প্রতীকের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা দেখাতে পারে না, সেখানে কীভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব?
প্রশাসন ও উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে অভিযোগ করে নাহিদ বলেন, জনপ্রশাসনে দলীয়করণ হয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে। এমনকি উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকেও এ ব্যাপারে সহায়তা করা হচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দলীয়করণের অভিযোগ আছে প্রধান উপদেষ্টাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, তারা উপদেষ্টা পরিষদের পরিবর্তন চান না। তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রত্যাশা করেন।
ওদিকে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। তিনি বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনোভাবেই নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি বরং তারা ‘কিছু নির্দিষ্ট দলকে সুবিধা দিয়ে ম্যানেজ করে চলছে।’
মঙ্গলবার এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেন, স্বজনপ্রীতিবাজ এসব উপদেষ্টারা কতোটুকু নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে পারবে, সেটি নিয়ে এখন দেশ জুড়ে সংশয় ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
তিনি লিখেন, নির্বাচনের আগে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের রদবদল নয়, উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যেও শুদ্ধি অভিযান চালানো জরুরি। তার মতে, যেসব উপদেষ্টা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের সরিয়ে দিয়ে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা উচিত।
রাশেদ খান বলেন, বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। যেসব উপদেষ্টারা দুর্নীতি করেছেন, আত্মীয়স্বজনকে বিভিন্ন জায়গায় পুনর্বাসন করেছেন, সরকারকে নিজেদের বাপদাদার সম্পদ মনে করেছে তাদেরকে আজ হোক, কাল হোক, জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে উপদেষ্টা পরিষদে অবিলম্বে পরিবর্তন আনা ছাড়া বিকল্প নেই।