Image description
সাব-জেলে ১৫ সেনা কর্মকর্তা

জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের আমলে সংঘটিত হত্যা, গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ৩ মামলায় সেনা হেফাজতে থাকা সেনাবাহিনীর ১৫ কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। গতকাল ভোরে কড়া নিরাপত্তায় এসব আসামিকে আদালতে হাজিরের পর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ নির্দেশনা দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। একইসঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পলাতক অন্য আসামিদের আগামী ৭ দিনের মধ্যে আদালতে হাজির হতে দু’টি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। 

এসব মামলা তিনটির মধ্যে দু’টি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনার। অন্যটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। গুমের দু’টি মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ২০শে নভেম্বর এবং রামপুরার মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য ৫ই নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

১৫ সেনা কর্মকর্তা হলেন- ৩টি মামলার মধ্যে প্রথম মামলাটি হচ্ছে র‌্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে অপহরণ। এ মামলায় গুম ও নির্যাতনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে ৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত ১০ আসামি হলেন- কর্নেল একেএম আজাদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল, কর্নেল মো. সরওয়ার বিন কাসেম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুব আলম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম ও কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান।

অপর আরেকটি মামলায় জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারে (জেআইসি) গুমের অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেক মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার ৩ আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন-মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিক। এ ছাড়া, গত বছর জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালে ১৮ই ও ১৯শে জুলাই রাজধানীর রামপুরায় গুলি করে ২৮ জনকে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা আরেক মামলায় ৪ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার দুইজনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এই মামলায় ৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এদের মধ্যে হাজির করা দুই আসামি হলেন-লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রেদওয়ানুল ইসলাম ও মেজর রাফাত বিন আলম মুন। 

প্রিজন ভ্যানটি ছিল দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু: গতকাল সেনা কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে আনার প্রেক্ষাপটে ট্রাইব্যুনালকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, এপিবিএনের বিপুল সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতি ছিল অন্যদিনের চেয়ে একেবারেই আলাদা। সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে একটি বিশেষ প্রিজন ভ্যানে করে সাধারণ পোশাকে ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। কারা কর্তৃপক্ষের ‘বাংলাদেশ জেল, প্রিজন ভ্যান’ লেখা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষ প্রিজন ভ্যানটি ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ঢুকতেই সবাই ভিডিও, ছবি তোলা শুরু করে। এ সময় ভ্যানটিকে ঘিরে কড়া নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে পুলিশ। এরপর একে একে গাড়ি থেকে নামানো হয় সেনা কর্মকর্তাদের। তাদের সবাই ছিলেন সাদা পোশাকে। কারও কারও মুখে ছিল মাস্ক। পরে তাদের ট্রাইব্যুনালের গারদখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

শুনানিতে যা বলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী: গতকাল বেলা সোয়া ৮টায় টিএফআই সেলে গুমের অভিযোগে গ্রেপ্তার ১০ সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে আসামিদের জন্য নির্ধারিত ডকে তোলা হয়। এসময় চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে জানান, এই মামলায় গ্রেপ্তার আসামিরা ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়েছেন। এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি আইন অনুযায়ী পলাতকদের পক্ষে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার আবেদন ও মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্যের আবেদন করেন। এসময় ট্রাইব্যুনাল আসামিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমরা নাম বললে আপনারা একটু দাঁড়াবেন। যেনো কার নাম কি তা শনাক্ত করা যায়। পরে নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে  একে একে সবাই উঠে দাঁড়ান। অতঃপর ট্রাইব্যুনাল পলাতকদের ব্যাপারে দু’টি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়ে আগামী ২০শে নভেম্বর পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেন। পাশাপাশি আসামিদের কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন। 
পর্যায়ক্রমে জেআইসি ও রামপুরা মামলার আসামিদের তোলা হলে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম একই আবেদন করেন। পরে ট্রাইব্যুনাল জেআইসি মামলায়ও একই দিন ধার্য করেন। তবে রামপুরা মামলার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালকে তাজুল বলেন, এই মামলায় মোট ৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলার একটু কম সময় দিয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য তারিখ নির্ধারণের আবেদন করেন তিনি। পরে ট্রাইব্যুনাল ৫ই নভেম্বর দিন ধার্য করেন।

গতকাল অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম মানবজমিনকে বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবী মৌখিক ভাবে দু’টি আবেদন করেছিলেন, একটি হলো আসামিদের ওকালতনামায় স্বাক্ষর গ্রহণ করে তাদের উকিল হওয়ার অনুমতি। অপরটি হলো আসামিদের সঙ্গে প্রিভিলেইজ কমিউনিকেশন (কথা বলা) করতে চায়। এ দু’টি আবেদনই ট্রাইব্যুনাল মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু আসামিপক্ষের আইনজীবী আরও দু’টি আবেদনের কথা ট্রাইব্যুনালকে বলেন, একটি হলো আসামিদের জামিন আবেদন। অপরটি আসামিরা সরাসরি ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত না হয়ে অনলাইনে হাজিরা দেয়ার আবেদন। জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপনি তো তাদের উকিলই হননি। ওকালতনামা ফাইল করার পরে এসব আবেদন দাখিলের কথা জানায় ট্রাইব্যুনাল।

সেনাবাহিনী পূর্ণ সহযোগিতা করেছে: মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে সেনাবাহিনী পূর্ণ সহযোগিতা করেছে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আজ যাদের উপস্থিত করা হয়েছিল, তাদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে, সোপর্দ করার ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন কাজ করেছে, তেমনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের রক্ষক হিসেবে যাদের মনে করা হয়, সেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই আদালতের প্রক্রিয়াকে সাহায্য করেছে। তারা ঘোষণা দিয়েছিল, বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের সব সমর্থন থাকবে। তারা সেই সমর্থন তাদের (প্রসিকিউশন) দিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়েছে। এই আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করার ব্যাপারে তারা (সেনাবাহিনী) সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে জানতে পেরেছেন বলে জানান তিনি। সেনাবাহিনীকে নিয়ে অপপ্রচার না করার আহ্বান জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, বিচার প্রক্রিয়াই একটি রাষ্ট্রের সভ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করে। একটি রাষ্ট্র কতোটা ‘ফাংশনাল’ আছে, সেটা নির্ধারিত হয় সে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ কতোটা ‘স্মুতলি ফাংশন’ করে। তাই এই বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনায় যারা সহযোগিতা করেছেন, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি। তাজুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনী যেমন জুলাই-আগস্টে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের সময় রুখে দাঁড়িয়েছিল বা মাঝখানে ভূমিকা পালন করেছিল, যেটা জাতি স্মরণ করে। একইভাবে গুমের বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও তারা সহযোগিতা করছে, আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। 

যাদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির নির্দেশ দেয়া হয়েছে: এসব মামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক-বর্তমান ২৫ সেনা কর্মকর্তাসহ মোট আসামি ৩২ জন আসামি করা হয়েছে। যার মধ্যে ১৭ জন আসামি পলাতক রয়েছে। পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে ৭ দিনের মধ্যে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে বলা হয়েছে।

এসব আসামিরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। এ ছাড়া র‍্যাবের সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম। ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচজন মহাপরিচালক-লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদিন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী ও মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক। ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক-মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ তৌহিদুল-উল ইসলাম, মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মখছুরুল হক। র‍্যাবের সাবেক তিন মহাপরিচালক-বেনজীর আহমেদ (পরে আইজিপি হন), এম খুরশিদ হোসেন ও মো. হারুন-অর-রশিদ এবং পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদুল ইসলাম ও সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমানকেও হাজির হতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।