
বগুড়ার প্রাচীন পর্যটন কেন্দ্র মহাস্থানগড়ে বাস থেকে নেমেই বিপদে পড়তে হলো। ২০ সেপ্টেম্বর ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বাস থেকে নেমে পাশের দোকানে ভোঁ দৌড়। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন হোটেল-দোকান-শেডের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন শতাধিক মানুষ। বৃষ্টি আর থামে না। ঢাকার পাইকারি কাঁচাবাজারগুলোতে পাঠানোর লক্ষ্যে বৃষ্টিতে ভিজেই নানান জাতের সবজি ট্রাকে লোড করা হচ্ছে। মহাস্থানগড় দর্শনীয় স্থান, বগুড়ার সবচেয়ে জনবহুল এলাকা। বৃষ্টি কমে যাওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে বেড়াতে আসা মানুষজন বিভিন্ন দর্শনীয় স্পটে চলে যাচ্ছে। একটি হোটেলে স্থানীয় এক নেতার সঙ্গে খাবার খেয়ে উঠতে যাব এমন সময় গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় পেয়ে অনেকেই নিজের থেকেই কাছে এসে পাশের চেয়ারে বসে কথা বললেন। তারা জেলার রাজনীতি ও নির্বাচনের চালচিত্র নিয়ে জানালেন। মহাস্থানগড়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয়।
কেউ এসেছেন নওগাঁ থেকে কেউ গাইবান্ধা, কেউ এসেছেন নাটোরের বিভিন্ন উপজেলা থেকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী বেহুলার বাসরঘর, প্রতœতাত্মিক জাদুঘর দেখতে এসেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলাম জানালেন, বগুড়া হচ্ছে বিএনপির দুর্গ। এখানে জামায়াতের ব্যাপক প্রচারণা দেখলেও নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। শহীদুলের সঙ্গে বেড়াতে আসা নাসরিন জাহান জানান, বগুড়াই কেবল নয় রাজশাহী বিভাগের ৩৯ আসনের তিন-চতুর্থাংশ আসন বিএনপিই পাবে। বছরদেড়েক আগেও রাজশাহীতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে আসতে ভয় পেতেন। ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনের ভয় এবং নানা রকম পুলিশি হয়রানিতে দলটির বেশির ভাগ নেতাই আত্মগোপনে থাকতেন। প্রকাশ্যে মিছিল-সমাবেশ করলেও পুলিশ ঘিরে রাখত। মিছিল থেকে নেতাকর্মীদের আটক করা হতো। রাজশাহী বিভাগের বেশির ভাগ জেলায় এমন পরিস্থিতি ছিল যে দলীয় কার্যালয়েও বিএনপির নেতাকর্মীরা আসতে পারতো না। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর চিত্র পাল্টে গেছে। নির্বাচনী মাঠে এখনো না নামলেও দলটির নেতাকর্মীরা অনেকটাই চাঙা। মনোনয়ন পেলেই এমপি হওয়া নিশ্চিত এমন চিন্তা-ভাবনা থেকে কয়েকটি আসনে বিএনপির অভ্যন্তরে পুরোনো কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে। বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগামী রমজানের আগে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে। দলটির পক্ষ থেকে প্রতিটি আসনে প্রার্থী দেয়া হয়েছে। তারা সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছেন।
ভোটারদের ডোর টু ডোর যাচ্ছেন। বিএনপিও প্রচারণা চালাচ্ছে ঢিলেঢালাভাবে। কয়েকজন জানালেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণ-অধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বাসদ, জাসদ ও সিপিবির নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও দলগুলোর নেতাদের এখনো নির্বাচনমুখী কর্মসূচিতে সেভাবে দেখা যায়নি। সম্প্রতি রাজশাহী জেলা ও মহানগরের সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। বিএনপির ঘাঁটি বগুড়ায় বিএনপির ঢিলেঢালা প্রচারণা কেন? জানতে চাইলে বগুড়া শহরে বসবাস করেন এবং তিন যুগের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করেন মোহসিন রাজু জানালেন, বগুড়ায় জামায়াত ব্যাপকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘জামায়াতের নেতাকর্মীরা ফজরের নামাজ পড়ে বের হন, এশার পর ঘরে ফেরেন। ডাকসু, জাকসুতে শিবিরের বিজয়ের বার্তা নিয়ে জামায়াত ঘরে ঘরে যাচ্ছে। জামায়াতের তুলনায় বিএনপির কর্মতৎপরতা কম। কারণ আওয়ামী লীগ পালানোর পর বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁয় বিএনপির জনসমর্থন এমন যে বেশির ভাগ আসনে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোটার বিএনপির ফিক্সট। বাকি ভোট নানা ধারায় ভাগ হবে। বিএনপির নেতৃমূল নেতাকর্মীদের দাবি দ্রুতি দলীয় প্রার্থীর ঘোষণা দেয়া হোক। প্রার্থী ঘোষণা দেয়া হলে দলটির নেতারা সিরিয়াসভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় নামবে। তখন যে সব আসনে প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ সেগুলো কেটে যাবে’। মহাস্থানগড় দর্শনীয় স্পটে যখন বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা হয় তখন শিবগঞ্জ উপজেলার একজন ব্যবসায়ী জানান, বগুড়ার-৭ আসনের ৬টিতে বিএনপির দলের প্রার্থী দিলেও শিবগঞ্জ আসনে শরিক দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে প্রার্থী করা হবে এমন প্রচারণা রয়েছে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২ আসনে জনতা মুক্তি পার্টির ব্যানারে ভোট করেছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে আসনটি ছেড়ে দেয় বিএনপি। ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি জাতীয় পার্টির শরিফুল ইসলামের কাছে হেরে যান।
উত্তরাঞ্চলে মোট আসন সংখ্যা ৭২টি। রংপুর বিভাগ হওয়ার পর বৃহত্তর রংপুর ও বৃহত্তর দিনাজপুরে চলে যায় ৩৩টি আসন। ফলে রাজশাহী বিভাগের ৭ জেলায় আসন সংখ্যা ৩৯টি। রাজশাহীর ৬টি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৩টি, জয়পুরহাটের ২টি, পাবনায় ৫টি, নাটোরে ৪টি, বগুড়ায় ৭টি, নওগাঁয় ৬টি, সিরাজগঞ্জে ৬টি সংসদীয় আসন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে অন্যান্য দল খুব বেশি আসন পায়নি। আওয়ামী লীগ পালানোর পর ৫-৬টি আসন ছাড়া জামায়াতের কর্মী সমর্থন বেশি মনে করা হলেও অন্য সবগুলো আসনে বিএনপির কর্মী-সমর্থকের পাল্লা ভারী। স্থানীয় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক জানান, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ নির্বাচন এখন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এসব জেলায় বিএনপি এত বেশি প্রভাব যে অন্যান্য দল যতই প্রচারণা করুক ভোটের মাঠে তেমন সুবিধা করতে পারবে না। আর সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জেও বিএনপির প্রাধ্যান্য। তবে এ চার জেলায় জামায়াত দু-একটি করে আসন পেলেও পেতে পারে।
বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন একজন সাংবাদিক নাম প্রকাশের অনিচ্ছা প্রকাশ করে বলেন, বিএনপি এতদিন ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট দাবি করেছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকার ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অথচ জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালালেও বিএনপির খবর নেই। বিএনপির নেতৃত্বের উচিত দ্রুত প্রার্থী ঘোষণা করে প্রচারণায় নামা। অবশ্য বিএনপির একাধিক নেতা জানান, তারা বসে নেই। এবার নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মীসভা, সচেতনতামূলক সভা সেমিনার করা হচ্ছে। প্রার্থী ঘোষণার পর বিএনপি পুরোদমে মাঠে নামবে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা, ব্যবসায়ী সমাজের অনেকেই জানান, বিএনপির ভোটের দুর্গ বগুড়ায় ভাগ বসাতে চায় জামায়াত। আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যেই বগুড়া-জয়পুরহাটে জামায়াতের নেতারা সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। দলের নারী সদস্যরা ঘরে ঘরে যাচ্ছেন।
তবে এ প্রতিবেদন যখন লিখছি তখন রংপুর থেকে একজন সাংবাদিক ও একজন রাজনৈতিক কর্মী ফোন করে জানালেন, ‘জামায়াতের লেগো থেকে ‘আল্লাহ’ ও ‘আকিমুদ দ্বীন’ শব্দ দুটি বাদ দেয়া এবং হিন্দুদের পূজায় দলটির নেতাদের যাওয়ার ঘটনা মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনা আগামী নির্বাচনে দলটির জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধসহ পাঁচ দফা দাবি নিয়ে জামায়াতের আন্দোলন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় জামায়াতের নির্বাচনী প্রচারণা প্রসঙ্গে বগুড়ার স্থানীয় বাসিন্দা সিনিয়র সাংবাদিক মোহসিন রাজু বলেন, ‘জামায়াতের ওই সব গ্রামার বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইয়ে খাটবে না। বিএনপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড় আওয়ামী লীগ পালানোর পর এসব জেলায় বিএনপির বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে শক্ত খেলোয়ার নেই। নির্বাচনী মাঠে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় জামায়াতের প্রচারণা দেখে অনেকেই মনে করছেন দলটি এবার বোধ হয় বহু আসন পাবে। রাজশাহী বিভাগে জামায়াতের ওই গ্রামার কাজ দেবে না’। এর আগে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন এবং জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে জামায়াতের আন্দোলনের কঠোর সমালোচনা করে নীলফামারীর জলঢাকার সাংস্কৃতির কর্মী মশিউর রহমান বলেছিলেন, ‘জামায়াত ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দল। তবে তাদের কোথায় চলতে হবে কোথায় থামতে হবে সেটা জানা উচিত। থামতে না জানলে এবারের আওয়ামী লীগ বিহীন নির্বাচনেও জামায়াতের আশাভঙ্গ ঘটবে। কারণ মানুষ পিআর পদ্ধতি বোঝে না এবং সংবিধানে সেটা নেই। পিআর পদ্ধতি চালু করতে হলে আগামী সংসদে তা পাস করতে হবে। আর নির্বাচন কমিশন এবং অন্তর্বর্তী সরকার পিআর পদ্ধতিতে ভোট করবে না। এ অবস্থায় জামায়াত পিআর পদ্ধতির দাবিতে আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে নির্বাচন করলে সেটাতে ভালো ফলাফল আসবে না। কারণ আন্দোলনে পরাজিতরা কখনো নির্বাচনে ভালো করতে পারে না’।