
আক্ষেপের অন্ত নেই বিএনপি’র। বারবারই আসনটি হয় হাতছাড়া। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচিত হলেও বিএনপি’র ভাগ্যে একবারও আসনটি জুটেনি। আর জুটবেই বা কী করে। এ আসন তো সব সময় ভাগ-বাটোয়ারায় চলে যায়। হয় জামায়াত, না হয় জমিয়ত প্রার্থীকে সমর্থন দিতে হয়েছে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। আসনটি হচ্ছে সিলেট-৫ আসন। জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট নিয়ে এ আসন। বলা হয়ে থাকে; আসনটি আলেমদের আসন। কথাটি পুরোপুরি মিথ্যা নয়। তবে আসনে আলেমরা বহু ভাগে বিভক্ত। কেউ জমিয়ত, জামায়াত, আবার কেউ খেলাফত মজলিসসহ অন্য দলে। ফুলতলীর পীরের অনুসারীদেরও ভোটব্যাংক রয়েছে। এবার কী হবে- এ প্রশ্ন বিএনপি নেতাদের। ভোটের হিসেবে বিএনপি’র নিজস্ব ভোট ব্যাংক কম নয়। বলতে গেলে টুইটুম্বুর। ধানের শীষের প্রার্থী দিলেই পাস। এমন পরিস্থিতিতেও স্বস্তিতে নেই নেতাকর্মীরা। আর বিএনপি’র সম্ভাব্য প্রার্থীরা তো রীতিমতো মাতম করছেন।
তাদের দাবি- এবার এ আসনে ধানের শীষ হাতছাড়া হলে বিএনপি পুরোপুরি নির্বাসনে চলে যাবে। এবারই সুযোগ আসন ধরে রাখার। গণ-অভ্যুত্থান অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। ভোটের হিসাবও অনেক পরিবর্তন। ৯১’র নির্বাচনে এ আসনটি একবারই পেয়েছিল বিএনপি। তখন প্রার্থী ছিলেন প্রয়াত নেতা আবুল হারিছ চৌধুরী। নতুন প্রার্থী হওয়ার কারণে সুবিধা করতে পারেননি। ৯৬’র নির্বাচনে কেউ প্রার্থী হননি। হারিছ চৌধুরী প্রার্থী না হওয়ায় অন্য কাউকে প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। ২০০১ সালে এ আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন হারিছ চৌধুরী। কিন্তু জোটের ভাগ-বাটোয়ারায় আসনটি পায় জামায়াতে ইসলামী। ৯৬’র নির্বাচনে অঞ্চলভিত্তিক ভোটের হিসাবে এগিয়ে যাওয়া জামায়াত প্রার্থী ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী পরের নির্বাচনে পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩২ হাজার ভোট। চারদলীয় জোটবদ্ধ ওই নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটই বিএনপি’র ছিল বলে স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন। ২০০৮ সালে একই পরিণতি। ভাগ-বাটোয়ারায় আসন হারায় বিএনপি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ আসন থেকে বিএনপি’র মনোনয়ন পেয়েছিলেন জেলা বিএনপি’র সিনিয়র নেতা মামুনুর রশীদ চাকসু মামুন। ঐক্যফ্রন্টের আসন ভাগাভাগিতে এ আসনটি যায় জমিয়তের ঘরে। তবে জমিয়ত প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক দিনশেষে ফলাফল ঘরে তুলতে পারেননি। বিএনপি’র নেতারা জমিয়ত সভাপতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুকের ভোটের হিসাব বুঝাতে গিয়ে পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন- ২০০৮ সালে একক নির্বাচনে জমিয়তের হয়ে ওবায়দুল্লাহ ফারুক পেয়েছিলেন ৮ হাজার ৯০০ ভোট। পরে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ২০১৮ সালে পান ৮৬ হাজার ভোট। ওই সময় ভোটে মাঠে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। এই ভোটের বেশির ভাগই বিএনপি’র বলে দাবি করেন তারা।
হিসাবও বলছে; সিলেট-৫ আসনে অতীতে এককভাবে আলেম-ওলামারা জয়ী হতে পারেননি। জোটগত ভোটে ইসলামী দলগুলোর প্রার্থীরা জয় পান। সেখানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে বিএনপি’র দলীয় ভোট। তবে এককভাবে এ আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি’র প্রার্থীরা একাধিকবার জয়ী হয়েছেন। ভোটের হিসেবে এ আসনে বিএনপি’র ভোট রয়েছে ৩০ ভাগ। আওয়ামী লীগের ভোটেও একই হিসাব। আলেমরা ঐক্যবদ্ধ না থাকায় কখনো ইসলামী দলের নেতারা এককভাবে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ছাড়া বিগত দিনে নানা সময়ের নির্বাচনে জকিগঞ্জ ও কানাইঘাটের পৌর ও উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থীদের চমক ছিল। ১৮টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের মধ্যে অনেকেই বিএনপি’র দলীয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আসনের মোট ভোট ৪ লাখ ১০ হাজার। গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় বিএনপি’র ভোট বেড়েছে বলে ভোটাররা জানান। তারা বলেন, এবারের ভোটে এ আসনে ফ্যাক্টর হচ্ছে ফুলতলী পীরের অনুসারী এবং সংখ্যালঘু ভোটার। এ দুই অংশের ভোটে বিএনপি’র ভোটব্যাংক বেড়েছে। ২০১৮ সালে এ আসন থেকে বিএনপি’র মনোনয়ন পেয়েছিলেন জেলা বিএনপি’র জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মামুনুর রশীদ চাকসু মামুন। এবারো তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন- একটা বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে এ আসনটা হচ্ছে আলেমদের আসন। ভোটের হিসাব বা পরিসংখ্যান যাই বলেন কোনোটিই তাদের পক্ষে নয়। এ আসনে বিএনপি’র ভোটব্যাংক সিলেটের অন্য যেকোনো আসনের চেয়ে শক্তিশালী। মানুষ তার প্রিয় প্রতীক ধানের শীষে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। আমরা যেদিকে যাচ্ছি মানুষের সমর্থন ও সাড়া পাচ্ছি।
তিনি বলেন, বিএনপি’র নেতাকর্মীরা ৯১ সাল থেকে একদিনের জন্য এ আসনের মানুষকে ছেড়ে যায়নি। আসন ভাগ-বাটোয়ারা হলেও বিএনপি’র নেতাদের মুখের দিকে তাকিয়ে শরিক অংশকে দলের প্রার্থীকে বিএনপি’র কর্মী-সমর্থকরা ভোট দিয়েছেন। এবার নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ ধানের শীষের জন্য অন্তহীন অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানান তিনি। এ আসনে বিএনপি’র মনোনয়নপ্রত্যাশী আরেক প্রার্থী জেলা বিএনপি’র যুগ্ম সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাপলু জানিয়েছেন- অপ্রিয় হলেও সত্য এবারের নির্বাচনে সিলেট-৫ আসনে ধানের শীষ নির্বাসিত হলে বিএনপিও নির্বাসনে চলে যেতে পারে। এবার এ আসনে দলের অবস্থান বলেন আর ভোটের অবস্থান বলেন সবখানেই এগিয়ে বিএনপি।
কানাইঘাট উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি মামুনুর রশীদ চেয়ারম্যান মামুন জানিয়েছেন- ২০০১ সাল থেকে এ আসনটি বিএনপি’র জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ধানের শীষ প্রতীকে ভোট না হওয়ায় ফলাফল বোঝা যায়নি। একটিবার ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন হলে বুঝা যাবে এ আসনে জাতীয়তাবাদী দলের ভোটব্যাংক কেমন। তিনি বলেন-পরিস্থিতি এমন এবার এ আসনে বিএনপি থেকে ধানের শীষ প্রতীকে যেই নির্বাচন করবেন তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করবেন। এ আসনে ধানের শীষ প্রতীকের জন্য মাঠ চষে বেড়াচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপি’র সভাপতি জাকির হোসেন। তিনি জানিয়েছেন- সিলেট-৫ আসনের মানুষ ধানের শীষে ভোট দেয়ার জন্য যে মুখিয়ে আছে সেটি এবার বারবার শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের অবগত করা হয়েছে। আমাদের প্রাণের দাবি হচ্ছে জনপ্রিয়তা দেখে ধানের শীষের প্রার্থী দেয়া হলে অবশ্যই এ আসনটি বিএনপি’র ঘরে যাবে। তিনি বলেন- এবারো আমরা ভয়েস তোলায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। ইতিবাচক ফলাফল আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। জকিগঞ্জ পৌর যুবদলের সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক রিপন আহমদ জানিয়েছেন- আসনটি আলেম-ওলামাদের এ ধারণা ঠিক নয়। এ আসন বিএনপি’রও।