Image description

অবনতিশীল অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও রফতানির চাপে থাকা ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন দুঃসংবাদ নিয়ে এলো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে বন্দরের সেবা খাতে প্রায় ৪১ শতাংশ ট্যারিফ কার্যকর করতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এ সিদ্ধান্তে আমদানি-রফতানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, সংকটাপন্ন সময়ে এমন উদ্যোগ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য হবে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’।

নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় চার দশক পর ট্যারিফ বাড়ানো হলো। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে বন্দরসেবায় মাশুল বাড়ানো হয়েছিল। এবার অন্তর্বর্তী সরকার নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে বন্দরের ৫২টি খাতের মধ্যে ২৩টি খাতে ট্যারিফ সমন্বয় করেছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ভাড়া, টোল, ফি ও মাশুল ডলারের বিনিময়মূল্যের ভিত্তিতে আদায় করা হবে। প্রতি ডলারের হার ধরা হয়েছে ১২২ টাকা। ফলে ভবিষ্যতে ডলারের দাম বাড়লে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাশুলও বাড়বে।

সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কনটেইনার হ্যান্ডলিং খাতে। প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে নতুন ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা, যা আগে ছিল ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। এতে গড়ে প্রায় ৩৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আমদানি কনটেইনারে অতিরিক্ত দিতে হবে ৫ হাজার ৭২০ টাকা। রফতানি কনটেইনারে বাড়তি খরচ হবে ৩ হাজার ৪৫ টাকা। প্রতিটি কনটেইনার ওঠানামার ক্ষেত্রেও প্রায় ৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত গুনতে হবে। এতে সামগ্রিকভাবে কনটেইনার হ্যান্ডলিং খাতে ২৫ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বেড়ে যাবে।

উল্লেখ্য, দেশের সমুদ্রপথে আমদানি-রফতানির ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনার ও পণ্য পরিবহনের ৯৮ শতাংশই সম্পন্ন হয় চট্টগ্রামবন্দর দিয়ে। তাই নতুন এ ট্যারিফ সমন্বয় আমদানি-রফতানি ব্যয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অর্থনীতির সম্ভাব্য প্রভাব

অর্থনীতিবিদদের মতে, ট্যারিফ বাড়ানোর ফলে একদিকে আমদানি ব্যয় বাড়বে, অপরদিকে রফতানি খরচও বাড়বে। এতে— ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্য বেড়ে মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরও বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকতে পারে, ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্প খাতে কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বাড়ানোর কারণে উৎপাদন খরচও বাড়বে।

ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা

বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক  বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, অর্ডার হ্রাস ও ডলার সংকটে চাপে রয়েছে। তার ওপর বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানো হলে খরচ আরও বেড়ে যাবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে দুর্বল করবে, এমন আশঙ্কার কথা বলছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রামের সভাপতি ও বিজিএমইএ পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব বলেন, “সবচেয়ে বেশি চাপ পড়বে তৈরি পোশাক খাতে। কারণ কাঁচামাল আমদানির সময় একবার, আর রফতানির সময় আরেকবার বাড়তি মাশুল গুনতে হবে।”

বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তৈরি পোশাক শিল্পকে সরাসরি চাপে ফেলবে।’’ তার মতে, পোশাক শিল্পে এই অতিরিক্ত ব্যয় যোগ হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের দাম বাড়ানো সম্ভব হবে না। ফলে খরচ বৃদ্ধির পুরো চাপই উদ্যোক্তাদের ওপর পড়বে, যা পুরো সেক্টরের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ডেকে আনবে।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “এতে শ্রমিকদের বেতন বকেয়া পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে, ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বাড়বে। এমনকি এ কারণে কিছু গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।”

মহিউদ্দিন রুবেল আরও উল্লেখ করেন, ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর পরিবর্তে বরং বন্দরের অন্যান্য খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিলে সেটিই হতো সবচেয়ে যৌক্তিক পদক্ষেপ।’’

নাম প্রকাশ না করে আরেকজন পোশাক রফতানিকারক বলেন, “এখনকার সময়ে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নেওয়া সম্ভব নয়। বন্দরের চার্জ বাড়লে আমাদের লাভ থেকেই খরচ সামলাতে হবে। এতে ব্যবসা টেকসই থাকবে না।”

ব্যবসায়ীদের হিসাব অনুযায়ী, কনটেইনার হ্যান্ডলিং, লোড-আনলোড, সংরক্ষণ ও শিপিং চার্জ মিলিয়ে খরচ ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এটি কার্যত দ্বিগুণ ব্যয়ের মতো প্রভাব ফেলবে।

সরকারের যুক্তি

সরকারি সূত্র বলছে, দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে বন্দরের সেবা চার্জ বাড়ানো হয়নি। অবকাঠামো উন্নয়ন, আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে বাড়তি রাজস্বের প্রয়োজন রয়েছে। এশিয়ার ১০টি ও আন্তর্জাতিকভাবে ১৭টি বন্দর পর্যালোচনা করে চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, “আমদানিকারকরা বর্তমানে প্রতি কেজি পণ্যের জন্য ৩২ পয়সা মাশুল দেন। নতুন হারে এটি হবে সর্বোচ্চ ৪৪ পয়সা। তাই নিত্যপণ্যের দামে তেমন প্রভাব পড়বে না।”

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্দর লোকসানি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং প্রতিবছরই বিপুল রাজস্ব আয় হয়। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত ট্যারিফের বোঝা ব্যবসায়ীদের ওপর চাপানো কতটা যৌক্তিক—সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

নতুন ট্যারিফে কী কী বাড়ছে

সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মাশুল বেড়েছে কনটেইনার পরিবহনে। ২০ ফুটের কনটেইনারে মাশুল বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা (গড়ে ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি)। আমদানি কনটেইনারে খরচ বাড়ছে ৫ হাজার ৭২০ টাকা এবং রফতানি কনটেইনারে ৩ হাজার ৪৫ টাকা। প্রতি কেজি পণ্যের মাশুল ১ টাকা ২৮ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ টাকা ৭৫ পয়সা। কনটেইনার ওঠানো-নামানোর খরচ ৪৩.৪০ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮ ডলার। এছাড়া জাহাজ ভিড়াতে দেরি হলে ওয়েটিং চার্জও বাড়ানো হয়েছে। ৩৬ ঘণ্টার বেশি দেরি হলে অতিরিক্ত ৯০০ শতাংশ চার্জ গুনতে হবে।

ব্যবসায়ীদের প্রতিবাদ উপেক্ষিত

ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকেই ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো আপত্তি জানিয়ে আসছিল। তারা সর্বোচ্চ ১০-১২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বৈঠকেও একই দাবি তুলে ধরা হয়। উপদেষ্টা আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব কার্যকর হয়নি।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, “সারা দেশের ব্যবসায়ী নেতাদের ডেকে মিটিং করা হলো, কিন্তু তাদের কোনও প্রস্তাবই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।”

সমুদ্রবাণিজ্যে বড় প্রভাব

দেশে আমদানি-রফতানিনির্ভর সমুদ্রবাণিজ্যের ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনার পরিবহনের ৯৮ শতাংশ হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। অর্থাৎ এককেন্দ্রিক এই অবকাঠামোর ওপর ট্যারিফ বাড়ানোর প্রভাব সরাসরি পড়বে সমগ্র অর্থনীতিতে।

২০২৪ সালে বন্দর দিয়ে ৩২ লাখের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। শিল্পপণ্য আমদানি, কাঁচামাল সরবরাহ এবং তৈরি পোশাক রফতানি—সবকিছুতেই বর্ধিত ট্যারিফের প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবহারকারীরা।

তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একসঙ্গে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানো ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সরকারের যুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও দীর্ঘদিন পর সমন্বয় করা হলেও ব্যবসায়ীদের মতে, এ সিদ্ধান্ত প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস করবে এবং বিনিয়োগের পরিবেশও ঝুঁকির মুখে ফেলবে।

এর আগে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী—বন্দরের বিভিন্ন সেবা খাতে সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত মাশুল বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট পক্ষের প্রতিক্রিয়ার মুখে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ২০ সেপ্টেম্বর তা এক মাসের জন্য স্থগিত রাখেন।