Image description
সরজমিন কালিয়াকৈর

অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলীতে তৈরি কালিয়াকৈরের হাইটেক সিটি রেলস্টেশন। ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দৃষ্টিনন্দন এই স্টেশনটি তৈরি করা হয়েছিল অনেকটা কমলাপুর স্টেশনের আদলে। নান্দনিকতা আর আধুনিকতায় এটি দেশের অন্যতম সুন্দর রেলস্টেশন। এতে রয়েছে একটি প্ল্যাটফরম ও একটি লুপ। বাংলাদেশ রেলওয়ের বি শ্রেণির এই স্টেশনটি বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরত্বে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে অবস্থিত।  কিন্তু এই স্টেশনটিতে এখন থামে না ট্রেন। উদ্বোধনের পর পর দু’টি লোকাল ও একটি ডেমু ট্রেন থামলেও সেগুলোর চলাচলও বন্ধ। শুধুমাত্র ঢাকামুখী সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস থামলেও আসার পথে এখানে থামে না। অথচ স্থানীয় যাত্রীদের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। আশপাশের অনেক শিল্পকারখানার যাত্রীও রয়েছে। ট্রেন চালুর দাবিতে স্থানীয়রা আন্দোলনও করেছেন। তাতেও কাজ হয়নি। এদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ ব্যয়বহুল এই স্টেশনটির পরিচালনা খরচ মাসে ৫ লাখ টাকা। বছরে সরকারের খরচ হয় অন্তত ৬০ লাখ টাকা।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ককে কেন্দ্র করে স্টেশনটি নির্মাণে ২০১৫ সালে প্রকল্প নেয়া হয়। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত রেলস্টেশনটির মূল নকশা করা হয়েছে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনের আদলে। ২০১৬ সালে স্টেশনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রতিদিন গাজীপুর শিল্পাঞ্চল, বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি, ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের মধ্যে ১০ থেকে ২০ হাজারের বেশি যাত্রী যাতায়াত করবেন এমনটা ধরেই স্টেশনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশনের কার্যক্রম শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কের পাশে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন বিশাল পরিসরে এই স্টেশন উদ্বোধন করার পর এখান থেকে মাত্র একটি ডেমো ট্রেন চলাচল করতো। সে ট্রেনও করোনা প্রাদুর্ভাবের সময় থেকে বন্ধ। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় এ স্টেশনে ট্রেন থামানোর দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে বিলাসবহুল দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশনে থামানো হতো টাঙ্গাইল কমিউটার ও সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস। গত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর নানা কারণে এখন সে দু’টি ট্রেনও বন্ধ।

ঢাকামুখী সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস থামলেও আসার পথে থামে না। অথচ বিলাসবহুল এই রেলস্টেশনে আধুনিক টিকিট কাউন্টার, সিগন্যাল পদ্ধতি, উন্নতমানের ভিআইপি বিশ্রামাগার সবকিছু রয়েছে। এই স্টেশন হয়ে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল ও উত্তরবঙ্গের পথে ভারতেরসহ ৪৮টি ট্রেন চলাচল করতো। এর মধ্যে ভারতেরসহ ৮টি ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে ৪০টি ট্রেন চলাচল করলেও দীর্ঘদিন ধরে বিশাল এই স্টেশনে ট্রেন থামে না একটাও। ফলে সেবা না থাকায় টিন দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ভিআইপি বিশ্রামাগার। রাজশাহীর সিলসিটি, দিনাজপুরের একতা, খুলনার চিত্রা, নীলফামারীর নীল সাগর, সিরাজগঞ্জের সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস এই লোকাল ট্রেনগুলো আপ অ্যান্ড ডাউনে স্টেশনে থামলে স্বাচ্ছন্দ্যে কম খরচে চলাচল করতে পারবে ঢাকা, গাজীপুর, কালিয়াকৈর, সাভারসহ উত্তরবঙ্গের মানুষ। 

বিলাসী এই স্টেশনের মাসিক খরচ অন্তত ৫ লাখ টাকা হলেও রেলকর্মীরা বলছেন, এখান থেকে প্রথমদিকে আয় হতো মাত্র কয়েক হাজার টাকা। এখন সেটিও বন্ধ। এখন দেখভালের অভাবে নষ্ট হচ্ছে, উন্নত কাঁচের দেয়াল, স্টেশনের বিভিন্ন মূল্যবান স্থাপনা।
বিপুল ব্যয়ে দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশনটি এখন যেন শুধু টিকটক আর বিনোদন কেন্দ্র। এদিকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না থাকায় সুনসান নীরব পড়ে থাকছে দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশনটি। ফলে এটাকে কেন্দ্র করে চুরি, ছিনতাই, মাদকের আখড়াসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এ স্টেশনে ৮ জন জনবল থাকলেও নেই নৈশপ্রহরী। নিরাপত্তার অভাবে চুরি হয়ে যাচ্ছে স্টেশনটির বিভিন্ন মালামাল। গত কয়েকদিন আগেও চুরি হয়ে গেছে স্টেশনের পানির পাম্প। সেখানে নানা অপরাধ সংঘটিত হওয়ায় আতঙ্কে আছেন রেলস্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। কালিয়াকৈরের এনসিপি’র প্রধান সমন্বয়ক মাহবুব  মানবজমিনকে বলেন, আমার ভাই ঢাকার সরকারি একটি অফিসে চাকরি করেন। ট্রেন না থামায় প্রতিদিন কালিয়াকৈর থেকে কষ্ট করে বাসে যাতায়াত করেন। কালিয়াকৈরে বিপুল সংখ্যক যাত্রী রয়েছে। অথচ বিলাসবহুল এই স্টেশনে থামে না কোনো ট্রেন। তাহলে এত টাকা খরচ করে বিলাসবহুল এ স্টেশন দরকার কি ছিল? ফ্যাসিবাদী সরকার হরিলুট করার জন্যই ব্যয়বহুল এই স্টেশনটি নির্মাণ করেছিল। স্থানীয় বাসিন্দা আদনান বলেন, এ স্টেশনে একটাও ট্রেন না থামায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন চলাচলরত মানুষ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কারিগরি জটিলতার কারণে  স্টেশনটি  থেকে পূর্ণ সেবা দেয়া সম্ভব নয়। যাত্রীসেবা দিতে গেলে ব্যাহত হবে ট্রেন চলাচল।

বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলস্টেশনের মাস্টার খোরশেদ আলম বলেন, এ স্টেশনে আগে ডেমো ট্রেন থামলেও করোনাকালে সেটা বন্ধ হয়ে আছে। এ ছাড়া আরও দু’টি ট্রেন থামতো, সে দু’টিও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস যাওয়ার পথে থামলেও আসার পথে থামে না। ট্রেন থামলে প্রচুর যাত্রী হতো। কারণ কালিয়াকৈর ও চন্দ্রা এলাকায় শিল্প কলকারখানার অনেক যাত্রী স্টেশনে এসে ফিরে যায়। এই স্টেশনে ট্রেনের স্টপেজ দেয়ার সিদ্ধান্ত রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। এ বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই স্টেশনে ৮ জন স্টাফ কর্মরত রয়েছেন। বিদ্যুৎ বিলসহ স্টেশন রক্ষণাবেক্ষণে প্রচুর টাকা খরচ হলে আয় একেবারে সীমিত। সেটা উল্লেখ করার মতো নয়। 

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাউছার আহাম্মেদ মানবজমিনকে বলেন, এখানে স্থানীয় ট্রেন যাত্রীর অনেক চাহিদা রয়েছে। ট্রেন না থামার বিষয়টি নিয়ে রেল বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি।  তাদেরকে জানিয়েছি, যদি কারিগরি কোনো ধরনের ঝামেলা না থাকে তাহলে যেন এই স্টেশনে ট্রেনের স্টপেজ দেয়া হয়। এখন বিষয়টি রেল বিভাগ বিবেচনা করবে।