
জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে দেশের বাইরে পলাতক অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার হোতা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। যা আদালত অঙ্গনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। তার বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় শতকোটি টাকা পাচার (মানি লন্ডারিং) অবৈধ সম্পদ, অস্ত্র ও মাদকের মামলার পাশাপাশি জুলাই গণহত্যার অভিযোগে একাধিক মামলাও রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম ঝুলছে বছরের পর বছর। রয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানাও। এমন একজন আসামি কীভাবে আইনজীবীর মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন-তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সরকার পক্ষের আইনজীবীরা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের সহকারী কমিশনার হাসান রাশেদ পরাগ জানান, আসামি সম্রাটের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন, মানি লন্ডারিং, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র আইনে চারটি মামলা হয়। অবৈধ সম্পদ, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র আইনের তিন মামলা বিচারাধীন। মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত এখনো চলছে। এর বাইরে জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হতাহতের ঘটনায় একাধিক মামলার আসামি তিনি। এমন একজন আসামি এখনো আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে হাজিরা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম যুগান্তরের কাছে সম্রাটের হাজিরার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, এটা কীভাবে সম্ভব। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি আছে। একজন আসামি দীর্ঘ সময় ধরে কীভাবে আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দেন। এটা ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে নিজে থেকেই তার জামিন বাতিল করতে পারেন বা প্রসিকিউশন থেকেও আবেদন দিতে পারে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মো. মেহেদী মাকসুদ যুগান্তরকে বলেন, তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিচ্ছেন কিনা আমার জানা নেই। এটা তো আদালতের এখতিয়ার। যদি তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিয়ে থাকেন, তাহলে রাষ্ট্রপক্ষে যারা আছেন তারা এ বিষয়টি আদালতকে জানাতে পারেন। যেদিন মামলার তারিখ থাকে সেদিন রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসলি (পিপি) অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নেব। যদি সত্যতা পাই, আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।
সম্রাটের আইনজীবী আফরোজা শাহনাজ পারভীন হিরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তার দাবি সম্রাট আইনসম্মতভাবেই হাজিরা দিচ্ছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মানি লন্ডারিং মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন। কার্যবিধির ২০৫ ধারায় নিয়মিত তার হাজিরা দেওয়া হয়। এর বাইরে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না।
সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ১৯৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই অর্থ পাচারে এনামুল হক আরমান তাকে সহযোগিতা করে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। পরে ২০২১ সালের জুলাইয়ে তাদের বিরুদ্ধে ২৩২ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯১ টাকা পাচারের তথ্য পেয়ে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থাটি। তবে পাঁচ বছর পার হলেও সম্রাটের অর্থ পাচারের মামলার তদন্ত কার্যক্রম আলোর মুখ দেখেনি। বিদেশি তথ্য না পাওয়ার অজুহাতে তদন্ত ঝুলছে বছরের পর বছর।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মো. মেহেদী মাকসুদ বলেন, এটা অর্থ পাচারের মামলা। এ মামলার পর ২০২০ সালে তথ্য চেয়ে দুই দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিটেন্ট রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়। পরে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ফের এ রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়। তারা এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য আমাদের দেয়নি। তারা তথ্য দেবে না এ কথাও বলে না। যতদিন পর্যন্ত এই তথ্য না পাব সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। প্রাপ্ত তথ্য সাপেক্ষে এই মামলার প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১১ মে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় জামিনে মুক্তি পান সম্রাট। চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। ওইদিনের পর থেকে জামিনে থাকা আসামি সম্রাট আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ঘটে গেছে আরও বড় অপরাধের ঘটনা। জুলাই হত্যায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা এখন তদন্তাধীন। ৫ আগস্টের পর তিনিও দেশ থেকে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলায় সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় আগামী ২৩ অক্টোবর নতুন তারিখ ধার্য রয়েছে।
২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে সিআইডির উপপরিদর্শক রাশেদুর রহমান বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা মডেল থানায় এ মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, কাকরাইলের ‘মেসার্স হিস মুভিজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বসে মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় ‘অবৈধ কর্মকাণ্ড’ চালাতেন সম্রাট।
এর আগে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে তাকে নিয়ে কাকরাইলের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, পিস্তল ও বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণীর চামড়া উদ্ধার করা হয়। বন্যপ্রাণীর চামড়া রাখার দায়ে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরের দিন ৭ অক্টোবর র্যাব-১-এর ডিএডি আব্দুল খালেক বাদী হয়ে রমনা থানায় মাদক ও অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করেন। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ৬ নভেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১-এর উপপরিদর্শক শেখর চন্দ্র মল্লিক। এছাড়া একই বছরের ৯ ডিসেম্বর মাদক মামলায় সম্রাটের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১-এর এসআই আব্দুল হালিম। এর মধ্যে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে অস্ত্র ও ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার বিচার চলছে। এছাড়া জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা মামলাটি ঢাকার ষষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। এতে দুই কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।