
বিএনপি’র প্রতিপক্ষ এখন অন্য কোনো রাজনৈতিক দল নয়। দলটির প্রতিপক্ষ এখন নিজের দলের ভেতরেই ঢুকে পড়েছে। সারা দেশে দখল, চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এখন নিজ দলের নেতাকর্মীরা একে অপরের দুশমন। এর সঙ্গে কমিটি গঠন ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘর্ষ এবং মারামারি প্রায় প্রতিনিয়তই নিজেদের মধ্যে সংঘটিত হচ্ছে। আছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও। রয়েছে নির্বাচনকেন্দ্রিক এক আসনে ৩ থেকে ৪ জন করে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তারা একে-অন্যের প্রতিযোগী হয়ে মাঠে নেমেছেন। নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সমর্থকদের মধ্যেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় দল হিসেবে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন নেতারা। তাদের ভাষ্য- দখল, চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় কর্মী কিংবা নেতার যেমন সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে, একইসঙ্গে মানুষের কাছে বিএনপি’রও ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এসব ঘটনা যত বেশি সংঘটিত হবে বিএনপি’র প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস তত বেশি কমে আসবে। এই সুযোগ কাজে লাগাবে অন্যরা। যদিও দখল এবং চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে রয়েছে বিএনপি’র হাইকমান্ড। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ৫ই আগস্টের পর থেকে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সারা দেশে দল এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের চার থেকে সাড়ে চার হাজারেরও অধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি।
বিএনপি’র কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের পাঁচ নেতা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, প্রায় প্রতিদিন সারা দেশে কোথাও না কোথাও বিএনপি’র নেতাকর্মীদের দ্বারা দখল এবং চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে যেগুলো প্রকাশ্যে আসছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাকিগুলোর বিষয়ে কেউ কিছু জানছে না। কিন্তু ভুক্তভোগী এবং আশপাশের মানুষগুলো এই ঘটনা দেখছে। যারা দেখছে বা জানছে তারা তো আর বিএনপি’র প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতে পারছে না। যদিও বিএনপি’র হাইকমান্ড বারবার নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছেন। সবাইকে ধৈর্য ধরতে এবং জনগণের সঙ্গে থাকতে বলেছেন। এরপরও কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি এসব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আমরা তো সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যেখানে যে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, সেটা আমাদের দল থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে দায়ী কাউকে পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমরা সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিচ্ছি। এটা তো বিএনপি’র একার ব্যাপার না। এটা হলো সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপার। যদি সরকার মনে করে, চাঁদাবাজি হচ্ছে, সরাসরি তাকে আইনের আওতায় নিয়ে নেবে। এটা তো সরকারের করা দরকার। আর একটা বড় দলের প্রার্থী তো অনেক থাকবে। এটা সমন্বয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সমন্বয়ের মাধ্যমে যতটুকু ঠিক করা যায়, সেই চেষ্টা আমরা করছি।
ওদিকে, ৩রা সেপ্টেম্বর ফেনীর পরশুরামে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মঞ্চের সামনে বসাকে কেন্দ্র করে দলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। ৪ঠা সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে বিএনপি’র দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সাব-রেজিস্ট্রার অফিস দখল করে চাঁদাবাজি, চাঁদার টাকা ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই সংঘর্ষ হয়। ১১ই আগস্ট মাগুরা সদর উপজেলা চাউলিয়া ইউনিয়ন ৭ নম্বর ওয়ার্ড গোয়ালখালী মধ্যপাড়া এলাকায় বিএনপি’র ওয়ার্ড নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ১২ই আগস্ট ওয়ার্ড নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি’র দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১৪ই আগস্ট ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় বিএনপি’র কর্মিসভায় দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১৭ই আগস্ট নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনা মোড়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার স্ট্যান্ড দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপি’র দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে দু’জন গুলিবিদ্ধ হন। গত ১৩ই মে খুলনার দাকোপে খালের ইজারাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিএনপি’র দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। গত ১৬ই জুন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটি গঠন নিয়ে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১৭ই জুন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় সার্চ কমিটির বৈঠককে কেন্দ্র করে বিএনপি’র দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। এসব ঘটনার বাইরেও সারা দেশে বিএনপি’র কিছু নেতাকর্মীদের দ্বারা দখল, চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একাধিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স মানবজমিনকে বলেন, বিএনপি একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক দল। এখানে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মেলন ঘটে। আমাদের দলের মধ্যেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই রকম কিছু ব্যক্তির সমাগম ঘটেছে। সেটা অনেক ক্ষেত্রে বাছ-বিচার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যতটুকু আমরা পারি সতর্কতা অবলম্বন করে থাকি। আর গত একবছরে কিছু কিছু ব্যক্তি অসৎ উপায়ে দলের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে দল তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই সংখ্যা এখন অনেক কমে এসেছে। আর দলের কমিটি গঠন নিয়ে যে বিবাদ, এটা গণতান্ত্রিক একটা দলের মধ্যে হতেই পারে। সেটা যেন সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যদিয়ে সমাধান করা যায়, সেজন্য আমরা কাজ করছি।
অন্যদিকে, সম্প্রতি দখলদারি ও নির্বাচনী মনোনয়ন ঘিরে চট্টগ্রামের রাউজানে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ, গোলাগুলি এবং পাল্টাপাল্টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এই সংঘর্ষের ঘটনার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। কমিটি ও পদ স্থগিত করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এ ঘটনায় দুই পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করেছে।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের বড় দল। স্বাভাবিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিযোগিতা থাকবে। তারপরেও স্থায়ী কমিটি হচ্ছে মনোনয়ন বোর্ড। এই বোর্ড বসে যাচাই-বাছাইসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকে। যে প্রার্থী যোগ্য, ত্যাগী, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছে এবং এলাকায় জনপ্রিয়তা আছে- এসব বিবেচনায় নিয়ে আমরা মনোনয়ন দেবো। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। প্রতিযোগিতা হবেই। না হলে গণতন্ত্র কীভাবে হবে? আমাদের দলের অভ্যন্তরেও প্রতিযোগিতা হবে। পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচনে অন্য দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হয়। এটাই তো গণতন্ত্রের নিয়ম। দখল এবং চাঁদাবাজি নিয়ে অপপ্রচার বেশি হচ্ছে বলেও মনে করেন বিএনপি’র এই স্থায়ী কমিটির সদস্য।