Image description
জুলাই সনদ

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী আলোচনায় বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। দলগুলো তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করায় সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংবিধান সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া অন্যান্য প্রস্তাব বাস্তবায়নে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশ ব্যবহারে দলগুলো আংশিক সমঝোতায় পৌঁছালেও মূল বিতর্ক রয়ে গেছে সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে। বিএনপি সংসদকেন্দ্রিক সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছে, জামায়াত চাইছে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ ও এনসিপি নতুন সংবিধানের দাবিতে গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব জানিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ- এই চারটি পদ্ধতিকে সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে তুলে ধরলেও দলগুলো এখনো ঐকমত্যে আসতে পারেনি। আগামীকাল ঐকমত্য কমিশনে ফের বৈঠকে বসবে দলগুলো। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো সমাধান বা ঐকমত্য তৈরি হবে কিনা- সেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন রাজনীতিবিদরা। ওদিকে, কমিশনের পক্ষ থেকে সনদে স্বাক্ষরের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শনিবার বিকাল ৫টার মধ্যে দুজনের নাম পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। 

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অধ্যাদেশ এবং নির্বাহী আদেশে সেই সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে, যেগুলো সংবিধানকে স্পর্শ করে না। এ বিষয়ে লিখিত মতামত, মৌখিক মতামত সবসময় দেয়া ছিল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও একই রকম মতামত দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন আসছে, সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত ১৯টি মৌলিক বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, এগুলো বাস্তবায়নের জন্য কি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যায়, সেই বিষয়ে মতামতের জন্য কমিশন বৈঠক ডেকেছিল। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতামত দিয়েছে।

তিনি বলেন, আশু বাস্তবায়নযোগ্য যেকোনো সুপারিশ, যেগুলো জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নাধীন আছে এবং সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশের মধ্যদিয়ে অথবা অফিস আদেশসহ অন্যান্য বৈধ যেকোনো প্রক্রিয়ায়। যে প্রস্তাবগুলো আশু বাস্তবায়নযোগ্য নয়, অথচ বাস্তবায়ন করার সুযোগ আছে, সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য এই সরকার উদ্যোগ নিতে পারে, এমনকি সমাপ্তও করতে পারে, যদি সম্পন্ন না হয় পরবর্তী সরকার সেটা চালিয়ে যাবে, বাস্তবায়ন করবে।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ঐকমত্য কমিশন পাঁচটি বিকল্প দিলেও জামায়াতের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে। আশা করি, আলোচনার মাধ্যমে কাছাকাছি আসতে পারবো। সাংবিধানিক আদেশ জারি না হলে গণভোটকে বিকল্প হিসেবে রেখেছি।

জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির বলেছেন, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলেছি। সংস্কারের যেসব সিদ্ধান্ত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলো সংবিধানের উপরে প্রাধান্য দেয়া উচিত। 
গণ-অভ্যুত্থানের পর সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুসরণের সুযোগ নেই উল্লেখ করে শিশির মনির বলেন, সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ৫৭টি ইতিমধ্যে অকার্যকর। এজন্য সাংবিধানিক আদেশ প্রয়োজন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর অবস্থান ভিন্ন। কমিশনের সুপারিশগুলো সরকারের কাছে যাবে, তারপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে দলগুলো যদি অবস্থান না বদলায়, একমত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

সংবিধান সংশোধনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গণভোটের মতো প্রস্তাব অবান্তর। সংবিধান সভার নির্বাচনও হয় যখন কোনো সংবিধান থাকে না। আমরা বিদ্যমান সংবিধানকে গণতান্ত্রিক রূপ দিতে চাই। কিন্তু জামায়াতের প্রস্তাব ভয়ঙ্কর- রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশে সংবিধান পরিবর্তন সম্ভব নয়। এটি একটি বিপজ্জনক নজির হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, দলগুলো স্বাক্ষর করছে- এটাই যথেষ্ট। প্রয়োজনে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের মতামত চাইতে পারেন। এর বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে সেটা আত্মঘাতী হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন মানবজমিনকে বলেন, সংবিধানের মৌলিক যে বিষয়গুলোতে সংশোধনী আনতে হবে সেগুলোর সংশোধনী আনলে আর সংবিধানের চরিত্রই পাল্টে যাবে। যেকোনো সংশোধনীর মাধ্যমে আনলেও কোর্টে চ্যালেঞ্জের সুযোগ থেকে যায়। সংবিধান সভা বা গণপরিষদই উত্তম ও গণতান্ত্রিক উপায়। যার মধ্যদিয়ে ভবিষ্যতে যেকোনো বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। 

জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ মানবজমিনকে বলেন, সব কিছু হতে হবে আইনসম্মতভাবে। অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন সম্ভব নয়। এজন্যই এটাকে সংবিধান বলা হয়। তবে জুলাই সনদ নিয়ে বড় কোনো কনট্রোভার্সি হবে বলে মনে করি না।

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত আছে, কমিশনের প্রস্তাবও একেক সময় একেক রকম ছিল। এর ফলে বিলম্ব হচ্ছে। বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে সরকার চলছে, তাই গণভোট বা নতুন প্রস্তাব অনাকাঙ্ক্ষিত। এভাবে কখনোই একমত হওয়া যাবে না। 
তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদ একটি জাতীয় সনদ। এটি কোনোভাবে চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ও সদিচ্ছার উপরই নির্ভর করে।