Image description

রাজনৈতিক প্রতিকূলতার দীর্ঘ ১৭ বছর পাড়ি দিয়ে দেশের অন্যতম প্রধান ও বৃহত্তম দল বিএনপি যখন খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছিল, ১৭ বছরের ধারাবাহিক দমন-পীড়ন, কৌশলগত ভুল এবং নেতৃত্বের সংকটে দলটি যখন প্রায় অস্তিত্ব সংকটে পড়ে, তখনই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান খুলে দিল নতুন সম্ভাবনার জানালা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের সেই পটপরিবর্তন বিএনপিকে শুধু রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরিয়েই আনেনি, দিয়েছে ভুল শুধরে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর এক অভাবনীয় সুযোগ।

 
 

 

এই ঐতিহাসিক পটপরিবর্তনের পর থেকে বিএনপি এক গভীর আত্মশুদ্ধি ও নবজাগরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অতীতের ভুলের কঠোর আত্মসমালোচনা, বিতর্কিত জোটের রাজনৈতিক দায়ভার থেকে মুক্তি এবং প্রতিহিংসার রাজনীতির পরিবর্তে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে দলটি এক নতুন রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

যে দলটি এক সময় হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির জন্য পরিচিত ছিল, তারাই এখন নিয়মতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের কথা বলছে। শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূল পর্যন্ত, সর্বত্রই যেন এক নতুন প্রত্যয়ের সঞ্চার ঘটেছে। এটা কি নির্বাচনে জেতার জন্য বিএনপির সাময়িক কৌশল, নাকি এক গভীর আদর্শিক রূপান্তরের সূচনা? এই নবযাত্রার মাধ্যমে বিএনপি কি পারবে জনগণের আস্থা পুনরায় অর্জন করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে নেতৃত্ব দিতে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব উত্তর নিহিত রয়েছে দলটির বর্তমান কর্মকাণ্ড এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার গভীরে।

বিএনপির দীর্ঘ ১৭ বছরের রাজনৈতিক দুর্দশার পেছনে কেবল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন বা প্রতিপক্ষের নিরবচ্ছিন্ন আঘাতই একমাত্র কারণ ছিল না। এর গভীরে গাঁথা ছিল দলটির নিজেরই কিছু গুরুতর কৌশলগত বিচ্যুতি এবং আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল করে দিয়ে দলকে সাধারণ মানুষ থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে দিয়েছিল বলে মনে করা হয়।

যেকোনো রাজনৈতিক দলের পুনর্জন্মের জন্য প্রয়োজন হয় অতীতের ভুলের এক নির্মোহ ও সৎ পর্যালোচনার। কেন বিএনপিকে এতটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে এই আত্মসমালোচনা অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে, অতীতের সেই ভুলগুলোকে বিশ্লেষণ না করতে পারলে, বর্তমানে তাদের ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ প্রত্যয় ও গভীরতা অনুধাবন করা সম্ভব নয় বলে জানান রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।

শাসনতান্ত্রিক ও কৌশলগত ভুল

বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০০১ সালের বিজয় ছিল এক সোনালি সুযোগ। তবে ক্ষমতার সেই স্বর্ণশিখরে বসেই দলটি এমন কিছু শাসনতান্ত্রিক ও কৌশলগত ভুল করে, যা কেবল তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামায়নি, বরং পরবর্তী দেড় দশকের রাজনৈতিক নির্বাসনের মঞ্চও প্রস্তুত করেছিল বলে মতামত দেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়কাল ছিল নানা বিতর্কে পরিপূর্ণ। এ সময় দুর্নীতির অভিযোগ দলটির ভাবমূর্তিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবন নিয়ে শুরু হয় অপপ্রচার। সেই অফিসকে ‘বিকল্প ক্ষমতার কেন্দ্র’ হিসাবে প্রচারণা চালাতে থাকে আওয়ামী লীগসহ কিছু দল। সেই অপপ্রচারে হাওয়া দিয়ে গণমাধ্যম ‘হাওয়া ভবনকে’ ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি প্রতীক হিসেবেও সম্মিলিতভাবে বর্ণনা করতে থাকে। বিএনপি ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের এই বয়ান বা ন্যারেটিভ খণ্ডন করতে না পারা বিএনপির একটি বড় ব্যর্থতা। সে সময় বিএনপির সিনিয়র নেতারা এ বিষয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বা বিষয়টিকে উপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এটি ছিল বিএনপির একটি বড় ভুল।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে টানা পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি ছিল সেই সময়েরই পরিণতি। ক্ষমতার এই অধ্যায় শেষ হওয়ার পর, দলটি বিরোধী দল হিসেবে আরও মারাত্মক কৌশলগত ভুলের চক্রে প্রবেশ করে বলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করা। এই একটি ভুল বিএনপিকে সংসদীয় রাজনীতির মূল স্রোত থেকে ছিটকে দিয়ে কেবল রাজপথের একটি দলে পরিণত করে, যা তাদের রাজনৈতিক দর-কষাকষির ক্ষমতাকে প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

পরবর্তীতে সরকার পতনের লক্ষ্যে দলটি যখন হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির আশ্রয় নেয়, তখন পেট্রোল বোমার মতো নৃশংস ও সহিংস পন্থা অবলম্বন করে সাধারণ মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, এই ধ্বংসাত্মক রাজনীতি সরকারের প্রতি জন-অসন্তোষকে পুঁজি করার বদলে উল্টো বিএনপির প্রতিই সাধারণ মানুষকে বিতৃষ্ণ করে তোলে, যা দলটিকে রাজনৈতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ করে ফেলে।

রাজনৈতিক জোটের ভুল

বিএনপির রাজনৈতিক পদযাত্রায় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বাঁধা ছিল সবচেয়ে আত্মঘাতী এবং বিতর্কিত একটি অধ্যায়। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের মতে, এই জোট শুধু নির্বাচনী মিত্রতাই ছিল না, বরং ছিল দলটির উদার গণতান্ত্রিক পরিচয়ের সঙ্গে এক গভীর আদর্শিক সংঘাত, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির কাঁধে এক দুর্বহ ঐতিহাসিক দায়ভার চাপিয়ে দেয়। যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী শক্তি হিসেবে পরিচিত এবং যার শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো অভিযোগ বিদ্যমান, তাদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা ছিল বিএনপির ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে এক নির্মম পরিহাস বলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

এই জোটের বিষময় ফল সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে ২০০১-২০০৬ সালের শাসনামলে, যখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। এই একটি সিদ্ধান্তই বিএনপিকে ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থি জনমানস থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএনপিকে একটি মৌলবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত করায় বলে মনে করা হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তন বিএনপিকে সেই ঐতিহাসিক দায়ভার থেকে মুক্ত হওয়ার এক অভাবনীয় সুযোগ এনে দিয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

এই নতুন দিকনির্দেশনাকে আরও শক্তিশালী করেছে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা। ২১ আগস্ট নিজের ফেসবুক পেজ থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লিখেছেন, “বাংলাদেশ কোনো একক ব্যক্তির, কোনো গোষ্ঠীর এবং কোনো দলের নয়। এটি আমাদের সকলের। দল বা বিশ্বাস, জাতি বা জাতি নির্বিশেষে, বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী নির্বিশেষে, প্রতিটি নাগরিকের একটি গর্বিত পরিচয় রয়েছে—বাংলাদেশি হওয়া। বিএনপির রাজনীতি এই সরল সত্যের ওপর ভিত্তি করে যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার ভোগ করা উচিত। ”

এই বক্তব্য কেবল জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের আনুষ্ঠানিকতাই নয়, বরং এটি বিএনপির পক্ষ থেকে মৌলবাদের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে একটি অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গড়ার সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবে দেখতে চাইছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে বিএনপি তাদের অতীতের ভুলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটাতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।

তারুণ্যের সঙ্গে দূরত্ব

বিএনপির অন্যতম বড় ভুল ছিল দলের আদর্শিক অবস্থানকে তরুণ প্রজন্মের কাছে পরিষ্কার করতে না পারা। বিশেষ করে, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের সম্পর্ক নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়, যা দলের ছাত্র সংগঠনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে বলে মনে করেন প্রাক্তন ছাত্রনেতারা। ২০০৪ সালে ছাত্রশিবিরের এক সমাবেশে বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান বলেছিলেন, “ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির একই মায়ের পেটের দুই ভাই”। তার বক্তব্য ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। এই একটি মন্তব্য ছাত্রদলের জাতীয়তাবাদী ও উদার গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী কর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করে এবং ছাত্রদলকে আদর্শিকভাবে দুর্বল করে দেয় বলে মনে করেন প্রাক্তন ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ। এই ঘটনা প্রতিপক্ষ দলগুলোর কাছেও বিএনপিকে “মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক” হিসেবে চিত্রিত করার একটি শক্তিশালী অস্ত্র তুলে দেয় বলেও মনে করেন তারা। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং আধুনিক মনস্ক তরুণদের একটি বড় অংশ ছাত্রদল তথা বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বলে তারা মনে করেন।

সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতৃত্বের সংকট

বিএনপির রাজনৈতিক সংকটের কেন্দ্রে ছিল জটিল এবং বহুমাত্রিক নেতৃত্বের সংকট। এই সংকট কেবল শীর্ষ পদের শূন্যতাতেই ছিল না, ছিল দলের সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে দেওয়ার মতো একটি অবস্থায়, যা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। একদিকে দলের ক্যারিশম্যাটিক নেতা এবং ঐক্যের প্রতীক চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে রাজনীতি থেকে কার্যকরভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। অন্যদিকে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ সময় ধরে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে বাধ্য করা হন। ভৌগোলিক এই দূরত্ব দলের দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্কাইপ বা অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে তিনি দলকে পরিচালনা করার চেষ্টা করলেও, একজন নেতার শারীরিক উপস্থিতি যে অনুপ্রেরণা ও শক্তি জোগায়, এর অভাব ছিল সুস্পষ্ট। ফলস্বরূপ, মাঠ পর্যায়ে কার্যকর নেতৃত্বের একটি দৃশ্যমান সংকট তৈরি হয়।

এই নেতৃত্ব সংকটের সরাসরি প্রভাব পড়ে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এক ধরনের স্থবিরতা ও দ্বিধা তৈরি হয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ২০১৮ সালের নির্বাচন। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তটি ছিল বিএনপির জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে চরম সমন্বয়হীনতা ফুটে ওঠে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা আসে একেবারে শেষ মুহূর্তে, এতে কর্মীরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে যথেষ্ট সময় পাননি বলে মনে করা হয়।

সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও এই সংকট প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। বিভিন্ন সময়ে বিএনপি যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, সেগুলো কর্মীদের উজ্জীবিত করতে ব্যর্থ হয়। এর মূল কারণ ছিল, মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন না। সিনিয়র নেতারা প্রায়শই কেবল প্রেসক্লাবের সামনে বা নয়া পল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সীমিত পরিসরে এসব কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। তৃণমূলের কর্মীরা, যারা পুলিশি হামলা ও মামলার ঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামবেন, তারা কেন্দ্র থেকে কোনো স্পষ্ট ও শক্তিশালী নির্দেশনা বা ভরসা পেতেন না। ফলস্বরূপ, কর্মসূচিগুলো কেবলই আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হতো, কার্যকর আন্দোলনে রূপ নিতে পারেনি।

নেতৃত্বের এই সংকটের সবচেয়ে বিধ্বংসী প্রভাব পড়েছিল তৃণমূলের ওপর। স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা একদিকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন, অন্যদিকে দলের কেন্দ্র থেকে কোনো কার্যকর সমর্থন বা দিকনির্দেশনা পাচ্ছিলেন না। বিভিন্ন জেলা ও মহানগরে কমিটি গঠন নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রায়ই প্রকাশ্য রূপ নিত। এতে দলের ঐক্য এবং সংহতিতে এমন ফাটল ধরে, যা থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

সংসদীয় গণতন্ত্রের ফাঁদ

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই মনে করেন, ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতির শাসন ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় উত্তরণ ছিল বিএনপির একটি কৌশলগত ভুল, যার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাংলাদেশ এখনও বের হতে পারেনি। যদিও এই পরিবর্তন তৎকালীন গণদাবি ছিল, কিন্তু এর প্রায়োগিক কাঠামোয় ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। এই ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে রাষ্ট্রের প্রায় সমস্ত নির্বাহী ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, যা ধীরে ধীরে সরকারপ্রধানকে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে এবং একটি “বিজয়ী দল সবকিছুর মালিক” সংস্কৃতির জন্ম দেয়। এই কাঠামোই পরবর্তীকালে বাংলাদেশে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতাকে শক্তিশালী করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে যেমন এই ক্ষমতার চর্চা করেছে, তেমনই ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে এর নির্মম শিকারও হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতার এই ভারসাম্যহীনতা দেশের রাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করেছে বলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা

একটি রাজনৈতিক দলের টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি একটি শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি এবং নিজস্ব বয়ান থাকা অপরিহার্য। বিএনপি এক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর একটি শক্তিশালী বয়ান তৈরির জন্য দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের তার পাশে পেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিএনপি নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানভিত্তিক মানুষকে দলে টানতে বা তাদের মূল্যায়ন করতে পারেনি। দল ক্ষমতায় থাকাকালে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিবর্তে আমলা ও ব্যবসায়ী-নির্ভর হয়ে পড়ে। এর ফলে দলটি নিজস্ব কোনো শক্তিশালী ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারেনি, যা দিয়ে তারা প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক প্রচারকে মোকাবিলা করতে পারে। আর এ কারণেই তারা প্রায়শই আওয়ামী লীগের তৈরি করা বয়ানের জবাব দিতে গিয়ে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

গণমাধ্যমের গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থতা

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে গণমাধ্যমের সঙ্গে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরি করার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। আবার ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে গণমাধ্যমকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে নিজেদের বক্তব্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের দুর্বল মিডিয়া সেল এবং ন্যারেটিভের অভাবের কারণে তারা প্রায়শই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর শিকার হয়েছে এবং নিজেদের অবস্থানও তাই ঠিকঠাক পরিষ্কার করতে পারেনি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।

১৭ বছরের নিপীড়নের খতিয়ান

২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালকে বিএনপি তার রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করে। দলটির অভিযোগ, এই সময়ে তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষ্যমতে, এই সময়কালে তাদের দলের প্রায় ৪০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এক লক্ষের বেশি ‘মিথ্যা’ ও ‘গায়েবি’ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এমনকি মৃত ব্যক্তি বা বিদেশে থাকা কর্মীদের নামেও মামলা দায়েরের মতো ঘটনা ঘটেছে।

গত ১৭ বছর বিএনপির জন্য কেবল ক্ষমতার বাইরে থাকার সময়কাল ছিল না; বরং ছিল এক বহুমাত্রিক রাজনৈতিক নিগ্রহের উপাখ্যান, যার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিলেন দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবার। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মতে, তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় কারারুদ্ধ করাই হয়নি, তার রাজনৈতিক কণ্ঠরোধ করতে নেওয়া হয়েছিল দৃশ্যমান সব পদক্ষেপ। কখনো বালুভর্তি ট্রাক দিয়ে দিনের পর দিন বাসভবন ঘিরে রেখে তাকে কার্যকর গৃহবন্দি করা, আবার কখনো প্রকাশ্য রাজপথে তার গাড়িবহরে অতর্কিত হামলার মতো ঘটনা ছিল তাকে জনবিচ্ছিন্ন করার এক পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের অংশ।

এই চাপ কেবল তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল তার পরিবার পর্যন্ত। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে এক প্রকার নির্বাসিত জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়, তার অনুপস্থিতিতেই দেওয়া হয় অসংখ্য মামলায় দণ্ডাদেশ। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর নির্বাসনে অকালমৃত্যু এই পারিবারিক ট্র্যাজেডির করুণতম দৃশ্য। শীর্ষ নেতৃত্বকে এভাবে কোণঠাসা করার পাশাপাশি তৃণমূলের ওপরও নেমে আসে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের স্টিমরোলার।

বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ভাষ্যমতে, লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলার পাহাড় তৈরি করা হয়, যেখানে মৃত ব্যক্তি বা প্রবাসীরাও আসামি হওয়া থেকে রেহাই পাননি। তবে সবচেয়ে গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল ‘গুম’ বা বলপূর্বক অন্তর্ধানের কৌশল। সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীসহ অসংখ্য নেতাকর্মীর অন্তরাল হয়ে যাওয়া কেবল ব্যক্তিবিশেষের ট্র্যাজেডি ছিল না; ছিল দলের প্রতিটি কর্মীর মধ্যে এক শীতল ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার এক নির্মম কৌশল। বস্তুত, শীর্ষ নেতৃত্বকে অবরুদ্ধ করে, পরিবারকে বিপর্যস্ত করে এবং তৃণমূলকে মামলা ও গুমের ভয়ে জর্জরিত করে বিএনপিকে একটি কাণ্ডারিহীন, ছত্রভঙ্গ এবং রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু শক্তিতে পরিণত করাই ছিল এই দীর্ঘ দমন-অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করেন বিএনপির নেতারা।

৫ আগস্টের পর ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ী সূচনা

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান রাজনৈতিকভাবে প্রায় নির্বাসিত বিএনপির জন্য কেবল একটি সুযোগ ছিল না; ছিল এক অভাবনীয় পুনর্জন্মের মুহূর্ত। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতায়, দেশের বৃহত্তম সংগঠিত শক্তি হিসেবে বিএনপি লাভ করে ইতিহাসের এক অনন্য সন্ধিক্ষণ। দলটি এই মুহূর্তটিকে কেবলই ক্ষমতার পালাবদল হিসেবে না দেখে, একে নিজেদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এক নতুন রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের সোপান হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

প্রতিহিংসা থেকে ঐক্যের পথে

৫ আগস্টের পর বিএনপির সবচেয়ে দৃশ্যমান পরিবর্তনটি ঘটেছে তাদের রাজনৈতিক ভাষায়। যে দলের অভিধানে একসময় ‘প্রতিশোধ’ বা ‘আন্দোলন-সংগ্রাম’-এর মতো শব্দ প্রাধান্য পেত, আজ সেখানে জায়গা করে নিয়েছে ‘সহনশীলতা’, ‘সমন্বয়’ এবং ‘জাতীয় ঐক্য’-এর মতো শব্দগুচ্ছ। এ প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেছেন, “আমরা কোনো জিঘাংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমাদের লক্ষ্য একটি ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ, যেখানে সবাই মিলে দেশটাকে গড়ব। ”

বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, এক দীর্ঘ সংঘাতপূর্ণ সময় পাড়ি দিয়ে আসা এই জাতি এখন আর প্রতিহিংসার রাজনীতি চায় না, বরং চায় ক্ষত নিরাময়ের প্রলেপ এবং একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কণ্ঠেও বারবার উঠে এসেছে, “আমরা কোনো প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। ” এই সংযমী বয়ান একদিকে যেমন সাধারণ মানুষ ও দ্বিধান্বিত সুশীল সমাজকে আশ্বস্ত করছে, তেমনই প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপির ভাবমূর্তি নির্মাণে সহায়তা করছে।

নেতৃত্বের রূপান্তর

বিএনপির এই নবযাত্রার অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তার নেতৃত্বেও এসেছে এক বিস্ময়কর রূপান্তর। অতীতে যিনি ছিলেন একজন আগ্রাসী সরকারবিরোধী সংগঠক, তিনিই এখন নিজেকে মেলে ধরছেন একজন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের অবয়বে। তিনি এখন গতানুগতিক ক্ষমতার রাজনীতির সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং দেশের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে মনোনিবেশ করছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। দলের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তার দৃঢ় ও সংযমী বক্তব্যও বেশ প্রসংশা কুড়াচ্ছে সর্বমহলে। লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক এবং একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ঐকমত্য স্থাপন তাকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিত্বের কাতারে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, পরিবেশ রক্ষার মতো বৈশ্বিক বিষয়ে তার পাঁচ দফা কর্মসূচি ঘোষণা প্রমাণ করে, তিনি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেন, যা তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে।

ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের লড়াই

বিএনপি তীব্রভাবে উপলব্ধি করেছে অতীতের দুর্নীতির অভিযোগ এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলই ছিল তাদের জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার অন্যতম কারণ। সেই ঐতিহাসিক দায় থেকে মুক্ত হতে দলটি এক কঠোর শুদ্ধি অভিযানে নেমেছে। এ প্রসঙ্গে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বাংলানিউজকে বলেন, “দলীয় শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে কেউ নন। জনগণের কাছে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক দল হিসেবে বিএনপিকে প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য। ” এই শুদ্ধি অভিযানের লক্ষ্য, দলের ভেতর থেকে সকল সুবিধাবাদী ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের ছেঁটে ফেলে দলকে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। এই অভিযান যে কথার কথা নয়, তার প্রমাণ মিলেছে দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে এখনো পর্যন্ত প্রায় দুই হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কারণ দর্শানো এবং বহিষ্কারের নোটিশ জারির ঘটনায়। এই কঠোর পদক্ষেপ দলের ভেতরে যেমন শৃঙ্খলার এক দ্ব্যর্থহীন বার্তা দিচ্ছে, তেমনই বাইরেও জনগণের কাছে এই আস্থা তৈরি করছে যে, বিএনপি সত্যিই তার অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে।

এককেন্দ্রিকতা থেকে বহুত্ববাদের পথে যাত্রা

বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনের সবচেয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তনটি হলো, এককভাবে দেশ শাসনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে একটি ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের ধারণা। দলটি এখন আর নিজেদের একক বিজয় নিয়ে ভাবছে না, বরং যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার এক অংশীদারিত্বমূলক কাঠামো তৈরির কথা বলছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপির প্রণীত ‘রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা’ প্রস্তাবকে ভিত্তি করে এই ঐক্য গড়ার প্রচেষ্টা প্রমাণ করে, দলটির লক্ষ্য কেবল শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন নয়, বরং রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর আমূল সংস্কার করা।

ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ঘুরে দাঁড়ানোর এই পথে বিএনপির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। দলের দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখনো একটি বড় সমস্যা। ক্ষমতার বলয়ে ফেরার পর স্বার্থের সংঘাত নতুন করে মাথাচাড়া দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তৃণমূল পর্যায়ে যারা দীর্ঘ ১৭ বছর নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের প্রত্যাশা এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কৌশলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এ ছাড়া, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট অর্জন করা এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করাও বিএনপির জন্য খুব সহজ হবে না বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, “শুধু রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নির্বাচনের আগেই নয়, অতীত ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি বিএনপি ধারাবাহিকভাবে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়, তবে তারা ভালো কিছু করতে পারবে। তা নাহলে আওয়ামী লীগের মতোই পরিণতি তাদেরও ভোগ করতে হবে। সামনের দিনগুলো তাদের জন্য সহজ হবে না। রাজনৈতিক দক্ষতার সঙ্গে এ সময়কে মোকাবিলা করতে না পারলে বিএনপিকে আবারও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। ”

অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাংবাদিক মারুফ কামাল খান এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, “অনির্বাচিত সরকার থাকলে নানা সমস্যা হয়, তাই বিএনপির প্রথম দাবি ছিল দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে তাদের এক সময় দ্বিমত থাকলেও লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর তারা একটি সমঝোতায় এসেছেন। নির্বাচনের একটা সময়সীমাও পাওয়া গেছে। প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যেই ইসিকে রোজার আগেই নির্বাচনের নির্দেশ দিয়েছেন। এটা বিএনপির একটা সফলতা। এ ছাড়া দলকে তারা ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছে, এটাও তাদের সফলতা। যুগপৎ আন্দোলনে তাদের সঙ্গে যারা ছিলেন, তাদেরও পক্ষে রাখতে পেরেছে। এর বাইরেও যারা ছিলেন, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী কিছু কিছু দলের সঙ্গেও তারা সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে। দলের ভেতরও বিভিন্ন অপকর্মে যারা লিপ্ত হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। যদিও শুধুমাত্র বহিষ্কারের মাধ্যমে এই সমস্যা নিরসন করা যাবে না। তারপরও দল শক্ত অবস্থান নিচ্ছে, এটার সঙ্গে আপোষ করছে না, এটা ভালো দিক। দল ও রাজনীতির সংস্কার ছাড়া এখান থেকে বের হওয়া যাবে না। এখন তো পুরোপুরি সম্ভব না, তবে সামনে করতে হবে। ”

চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বিএনপির সামনে অনেক সম্ভাবনাও রয়েছে। দেশের মানুষ একটি পরিবর্তন চায় এবং বিএনপি সেই পরিবর্তনের প্রধান অনুঘটক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যদি দলটি তার বর্তমান সংযমী, গণতান্ত্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত রাখতে পারে, তাহলে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, একটি সফল জাতীয় সরকার গঠন করতে পারলে তা কেবল বিএনপির জন্যই নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্যও একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

বিএনপি এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। অতীতের ভুলের বোঝা এবং ১৭ বছরের নিপীড়নের ক্ষত নিয়েও দলটি এক নতুন প্রত্যয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। নেতৃত্ব পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রদর্শন, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা এবং একটি জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। এই পথচলা মসৃণ হবে না, কিন্তু ৫ আগস্ট-পরবর্তী বিএনপি যে রাজনৈতিক পরিপক্বতা দেখাচ্ছে, তা যদি তারা ধরে রাখতে পারে, তবে দলটি কেবল বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তনই করবে না, বরং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণেও এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করার সুযোগ পাবে আশা ব্যক্ত করছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।