
শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে লড়ছেন একঝাঁক তরুণ। লক্ষ্য- বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করা। ৯ই সেপ্টেম্বর হতে যাওয়া নির্বাচনে শিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে রাইসুল ইসলাম ও খান জসিম নির্বাচনে লড়বেন। ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল থেকে আশিকুর রহমান, বামপন্থি সংগঠনগুলো ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ থেকে মাঠে নেমেছেন মো. তফসিরুল্লাহ।
শিবিরের ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন খান জসিম। ’২৪ আন্দোলনে পুলিশের ছররা গুলিতে বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান। ডান চোখে আংশিক দেখতে পান। জসিম বলেন, এটা আমার বোনাস লাইফ। ডাক্তার বলেছিলেন, আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম। আমি ছিলাম আর আট-দশজনের মতো সরকারি চাকরিপ্রার্থী। আমার স্থান ছিল রিডিং রুম। কিন্তু এখন আমি একচোখে দেখি না আরেক চোখে আমি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ব্যথা করে। আমি যন্ত্রণায় আর লিখতে পারি না, পড়তেও পারি না। সেই জায়গা থেকে আমি মনে করেছি, দেশের জন্য আমার চোখ চলে গিয়েছে তাই আমি বাকি জীবন দেশের জন্যই কাজ করবো। এজন্যই আমার ডাকসুতে আসা। তিনি আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে নির্বাচন করছেন।
এই প্যানেলে সদস্য পদে নির্বাচন করছেন রাইসুল ইসলাম। তিনি ৬ বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান। রাইসুল বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্ট্রাকচার, কোনো অবকাঠামো প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য অনুকূল না। যারা পলিসি বানান, তারা সকলেই শারীরিকভাবে সুস্থ। তাই সম্ভবত তারা আমাদের কষ্ট অনুধাবন করতে পারেন না। কেউ তাদেরকে হয়তো এ বিষয়টি স্মরণও করিয়ে দেন না। আমি চাই আমাদের এই প্রতিবন্ধী কমিউনিটিকে আরও বেশি ক্ষমতায়ন করতে। তাদের বার্গেনিং পাওয়ার তৈরি করতে, যেন তারা নিজেদের দাবিগুলো জানান দিতে পারেন।
স্বতন্ত্র খালিদ, মাহিন, এ্যানি’র নেতৃত্বাধীন ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ’ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক পদে নির্বাচন করছেন আশিকুর রহমান। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত হয়ে তার পায়ে ইনফেকশন হয়। এরপর থেকে বাধাহীন চলতে পারেন না তিনি। আশিকুর বলেন, আন্দোলনের সফলতার মুহূর্তে ৫ই আগস্ট লংমার্চে ঢাকা আসার সময় আশুলিয়াতে আটকা পড়ি। সেদিন আশুলিয়া স্পট ছিল অগ্নিগর্ভ। পুলিশের গুলির মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ি। দেয়াল বেয়ে পালানোর সময় টান মেরে নিচে ফেলে দেয় আমাকে। পুলিশ আমাকে লাথি দিতে থাকে। গুলি করার সময় পায়ে ধরি বলি আমি সাধারণ পথচারী, আন্দোলনকারী না। আমাকে যেতে দিন তারপর যেতে দেয়। ফেলে দেয়ার সময় পায়ে হালকা চোট লাগে। ভেবেছিলাম নরমাল চোট, পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আস্তে-আস্তে এটা গুরুতর হতে থাকে। ইনফেকশন হয়ে হাড় নষ্ট হয়ে যায়। তারপর হাড় কেটে ফেলে দিয়ে সেখানে বোন সিমেন্ট লাগানো হয়। ৪টা সার্জারি হয়। ১১ মাস আমি চিকিৎসাধীন ছিলাম। এখনো হাঁটতে সমস্যা হয়। তবু আমি নির্বাচন করতে চাই ছাত্রদের অধিকার রক্ষায়।
বামপন্থি সংগঠনগুলোর সমন্বিত প্যানেল ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ থেকে সদস্য পদে নির্বাচন করছেন মো. তফসিরুল্লাহ। জন্ম থেকেই আলোহীন তিনি। নির্বাচনে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীর শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। যারা সাধারণ তারাও যেমন শিক্ষার্থী আমরাও শিক্ষার্থী। কিন্তু আমরা দেখতে পাই এ ধরনের পলিসি মেকিং’র স্থানগুলোতে একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর কোনো রিপ্রেজেন্টেশন থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্ত অবকাঠামোগুলো আছে সেগুলো প্রতিবন্ধীদের জন্য অনুকূল না। তাই আমার নির্বাচনে আসা প্রতিবন্ধী কমিউনিটিকে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য। আমি নির্বাচিত হয়ে আসতে পারলে আমাদের প্রতিবন্ধী ভাইবোনদের সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করবো বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিবন্ধীদের অনুকূল পলিসি নিতে চেষ্টা করবো।
উল্লেখ্য, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ২০২৫ আগামী ৯ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ৫০৯ জন প্রার্থীর মাঝে শীর্ষপদ ভিপি (সহ-সভাপতি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ৪৮ জন। ডাকসু নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ২১শে আগস্ট প্রকাশ করা হয়েছে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা। ২৫শে আগস্ট মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। ২৬শে আগস্ট ঘোষণা করা হবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা। এদিকে ২৬শে আগস্ট অবধি প্রচার প্রচারণা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন-২০২৫’র নির্বাচনী বিধিমালা ৬(চ) অনুযায়ী, শ্রেণিকক্ষ, পাঠকক্ষ, পরীক্ষার হলসহ পাঠদান বা অধ্যয়ন ব্যাহত হতে পারে। এমন স্থানে সভা/সমাবেশ বা নির্বাচনী প্রচারণা করা যাবে না। আর বিধিমালা ১৭ অনুযায়ী, আচরণবিধি ভঙ্গের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা, প্রার্থিতা বাতিল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার বা আইন অনুযায়ী অন্যান্য দণ্ডের বিধান আছে। এদিকে ডাকসু নির্বাচনে আবেদনপত্রে ত্রুটি থাকায় প্রার্থিতা স্থগিত হওয়া ৪৭ প্রার্থীর মধ্যে আপিল করা ৩৪ প্রার্থীর সবাই নির্বাচনের সুযোগ পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মো. জসিম উদ্দিন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ভিপি নুরুল হক নুর (সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ) ও জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন গোলাম রব্বানী (ছাত্রলীগ)।