
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়। ইতিমধ্যে আট বছর পেরিয়ে গেছে। কবে মিয়ানমারে তাদের ফেরত পাঠানো হবে, তা এখনও নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্টরা। তবে সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিকভাবে এই সংকট সমাধানে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় রয়েছেন। যদিও এটি জটিল প্রক্রিয়া। যার সমাধান অচিরেই সম্ভব হবে বলে কোনও নিশ্চয়তা নেই।
এদিকে, এখনও নির্যাতনের কথা ভুলতে পারছেন না বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে সেসব কথা মনে হলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন নির্যাতনের শিকার নারী-শিশুরা। এসব ঘটনার কোনও বিচার পাননি। দেখছেন না কোনও সমাধান। এখনও জান্তা সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংঘাতের কারণে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আসছেন রোহিঙ্গারা। এ অবস্থায় কীভাবে ফিরবেন, তাও জানা নেই তাদের।
ফেরার আগে চান জীবনের নিরাপত্তা
নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে পালিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১ এ আশ্রয় নেন নুর জাহান। তিনি জানিয়েছেন, দীর্ঘ আট বছরেও ভুলতে পারেননি বর্বরোচিত নির্যাতনের ভয়াবহতা। এই নির্যাতনের দুঃসহ যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে নুর জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৭ সালে যখন রাখাইনে সহিংসতা শুরু হয়, তখন সে দেশের সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। শুরু হয় আমাদের ওপর নির্যাতন। কোনও উপায় না দেখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিই। পালিয়ে আসার সময় আমাকে এবং স্বামীকে ধরে নিয়ে যায় সেনাবাহিনী। সেনা ক্যাম্পে নিয়ে স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শেষে ওই ক্যাম্পে পাঁচ সেনাসদস্য পালাক্রমে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়। অনাহারে-অর্ধাহারে ছিলাম কয়েকদিন। এরপর অসুস্থ অবস্থায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথে দুটি যমজ সন্তানের একটির মৃত্যু হয়। কোনোমতে জীবন বাঁচিয়ে আশ্রয় নিই লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেই থেকে আট বছর পার হলেও ভুলতে পারিনি ওই নির্যাতনের ভয়াবহতা। এখন দুঃসহ নির্যাতনের কথা মনে পড়লে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এতটি বছরেও সেখানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। নির্যাতন চলছে। এ অবস্থায় কীভাবে আমরা সেখানে ফিরবো, জানি না।’
শুধু নুর জাহান একা নন, তার মতো অসংখ্য নারী রাখাইনে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পাশাপাশি নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হন অনেকে। কেউ স্বামী, কেউ স্ত্রী-সন্তান, আবার কেউ স্বজনদের হারিয়ে কক্সবাজারের ক্যাম্পে কোনোমতে জীবনযাপন করছেন। তবে প্রায় সব রোহিঙ্গা নাগরিকের ভাষ্য এমন, নিজ দেশে ফিরতে চান। তবে সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
অমানবিক নির্যাতনের একই বর্ণনা দিয়েছেন কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২-এর বাসিন্দা ফাতেমা বেগম। তার ভাষ্যমতে, ‘আট বছর আগে আমাকে রাখাইনে সেনাবাহিনী ও মগ যুবকরা ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছিল। আমার অনেক স্বজনকে গুলি করে হত্যা করেছিল তারা। চোখের সামনে স্বজনদের হারিয়েছি। এখনও সে কথা মনে হলে গা শিউরে ওঠে ওঠে। তবে আমার কোনোভাবে সে দেশে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। যদি যেতে হয় তাহলে নাগরিকত্ব দিলে যাবো। এর আগে রাখাইনে যাবো না। সেখানে যাওয়া মানেই মৃত্যু।’
প্রত্যাবাসন কার্যক্রম টেকসই হতে হবে
কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা জাফর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। নানা সংকটের মুখেও বাংলাদেশ আট লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়। এজন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আট বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। এখন আমরা নিজ দেশে ফিরতে চাই। কিন্তু প্রত্যাবাসন কার্যক্রম টেকসই হতে হবে। নানা কারণে বিশ্বনেতারা ভুলে যেতে বসেছেন রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ঘটনা। তাই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের গণহত্যার বিচারের পাশাপাশি দ্রুত সময়ে একটি সেভজোন করে সে দেশে থাকা রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচানোসহ কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার এখনই সময়।’
প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রত্যাবাসনের কোনও বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘের মহাসচিবের নেতৃত্বে একটি টিম রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের পর থেকে প্রত্যাবাসনে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে কক্সবাজারে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে। ২৪-২৬ আগস্ট পর্যন্ত ইনানীতে তিন দিনের এ সম্মেলনে ৪০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। এতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের অনেক বিষয় উঠে আসবে বলে আশা করছি।’
জানা গেছে, রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর পূর্তির দিন ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে ওই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সম্মেলনে কয়েকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রোহিঙ্গাবিষয়ক কয়েকজন আন্তর্জাতিক দূত, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা এবং বিশ্বের কয়েকটি দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরাও সম্মেলনে অংশ নেবেন।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া শুরুর কথা ছিল। কিন্তু প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে, তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি তখন। পরে প্রত্যাবাসনও শুরু করা যায়নি। সে সময় নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমিতে ফেরার নিশ্চয়তাসহ আট দফা দাবি জানিয়েছিল রোহিঙ্গারা।
এখনও নির্যাতনের কথা ভুলতে পারছেন না বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা
ওই সময় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মিয়ানমারবিষয়ক দূত ইয়াংহি লি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি স্বেচ্ছায় হতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। এরপর ২০২৩ সালের অক্টোবরে চীনের মধ্যস্থতায় এক হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে প্রকল্প নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পৃথক পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করে ডিসেম্বরে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
কক্সবাজারে ১৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিকের অবস্থান
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে বর্তমান নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত পেরিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দেড় লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে গত জুন পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছেন এক লাখ ২১ হাজার। আর অন্যরা নিবন্ধন ছাড়াই ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছেন। নতুন করে আসা এসব রোহিঙ্গার বেশিরভাগই নারী-শিশু। সবমিলিয়ে ১৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। কিন্তু গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।