পৃথিবীর দ্বিতীয় ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা। ২০২৫ সালে জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৬৬ লাখ। আয়তনে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম এই জনবহুল মেগাসিটি দেশের রাজধানী হলেও কার্যত অভিভাবকহীন। নাগরিকের সুবিধা-অসুবিধা দেখভালের জন্য অনেকগুলো সংস্থা রয়েছে। হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু দেখার কেউ নেই। রাজধানী ঢাকা শহরকে মেগাসিটি দাবি করা হলেও এটা কার্যত অনিশ্চয়তার শহর। নাগরিক সুবিধা বঞ্ছিতই শুধু নয়, পদে পদে এ শহরে অনিশ্চয়তা। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির তীব্র সংকট, বাতাস ভয়াবহ দূষিত। বাসা থেকে বের হলে কর্মক্ষেত্র বা গন্তবে কখন পৌঁছবেন কেউ জানেন না। যানবাহনের ১০ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে কখনো এক ঘণ্টা কখনো দুই-তিন ঘণ্টা লেগে যেতে পারে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সংস্থা এবং রাজনৈতিক দল যখন তখন রাস্তা দখল করে প্রতিদিন মিটিং মিছিল করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দেখছে। শত শত যানবাহন আটকে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সীমাহীন দুর্ভোগে নাগরিক জীবন বিপন্ন করে তুলছে। প্রতিদিন একই চিত্র-অভিন্ন চিত্র। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। দায়িত্বশীলদের নেই জবাবদিহিতা।
সরেজমিনে গত কয়েক মাসের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সকাল থেকেই চলমান আন্দোলন ও অবরোধ কর্মসূচির কারণে পুরো নগরীতে তৈরি হয়েছে তীব্র যানজট, বিশৃঙ্খলা ও যাত্রী ভোগান্তি। কর্মদিবসে এমন পরিস্থিতি শহরবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এক অসহনীয় দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। সকাল থেকে শুরু হওয়া অবরোধ দুপুর নাগাদ আরো বিস্তৃত হয়ে রাজধানীর মূল সড়কগুলোর যোগাযোগ প্রায় অচল করে ফেলে। ফলে অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থী, রোগীসহ সাধারণ পথচারী- সবাই পড়েন চরম বিপাকে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর পৃথক স্থানে শিক্ষার্থী, স্বাস্থ্যকর্মী ও পেশাজীবীরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে। মহাখালী, সায়েন্সল্যাব, আগারগাঁও, শাহবাগ ও শিক্ষা ভবনের সামনে আন্দোলনের ফলে ওইসব এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব পরেছে অন্য এলাকার সড়কগুলোতেও। যানজটের ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। অফিস ও নানা কাজে বের হওয়া লোকজন আটকে থাকেন যানজটে।
সাধারণ পথচারীরা বলছেন, আন্দোলন-অবরোধের অধিকার থাকলেও তা এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে সাধারণ নাগরিকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে না ওঠে। বিশেষ করে অফিস সময়, স্কুল সময়, হাসপাতালের রুট এসব জায়গায় অবরোধ না দেওয়ার অনুরোধ জানান নগরবাসীরা। নাগরিকদের দাবি, প্রতিটি আন্দোলনের ফলে আমাদের ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। এটা কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়। তাদের প্রশ্ন, দাবি-দাওয়া জানাতে সড়ক অবরোধ ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতি কী নেই?
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে আন্দোলন-অবরোধের ফলে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধু কর্মঘণ্টাকে বিপর্যস্ত করেনি বরং পুরো নগরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেই থমকে দিয়েছে। সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি এভাবে প্রতিবার জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে তা দীর্ঘমেয়াদে সমাজগত ক্ষতির কারণ হতে পারে। ঢাকার সড়ক নেটওয়ার্ক এতটাই দুর্বল যে সামান্য বাধা বা অল্প সময়ের অবরোধেও পুরো শহর অচল হয়ে পড়ে। রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থায় বিকল্প পথ বা রুট কম থাকায় কোনো এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি হলে জনজীবন থমকে যায়। ঢাকার লোড-ক্যাপাসিটি অত্যন্ত সীমিত। একই পথে হাজারো গাড়ি নির্ভর করে। তাই একটি পয়েন্ট বন্ধ হলে পুরো নেটওয়ার্কই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এটি নগর পরিকল্পনার দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা।
অবরোধ চলতে থাকায় দিনের উৎপাদনশীল সময় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। ব্যাংক, কর্পোরেট অফিস, গার্মেন্টস কারখানা, কুরিয়ার সার্ভিস প্রায় সব সেক্টরেই কাজের গতি কমে যায়। অনেক কর্মী নির্ধারিত সময়ে অফিসে পৌঁছাতে না পারায় কাজের সময় পিছিয়ে যায়, কিছু প্রতিষ্ঠানে মিটিং স্থগিত হয়। রাজধানীতে এক দিনের অবরোধের ফলে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হয় এবং বাজারে পণ্য পৌঁছাতে দেরি হয়, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তা মূল্যেও প্রভাব ফেলে।
রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, প্রেসক্লাব, ফার্মগেট, শান্তিনগর, সায়েদাবাদ, গাবতলী, মিরপুর, উত্তরা প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে যানবাহনের জটলা দেখা দিয়েছে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারীরা সড়কের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে সেøাগান দেন এবং মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধ মিছিলও করেন। এ সময় সাধারণ মানুষকে বিকল্প পথে যেতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু বিকল্প পথগুলোতেও জট সৃষ্টি হওয়ায় যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকেন।
সড়কে যানবাহনের গতি শ্লথ থাকার ফলে সবচেয়ে বেশি বিঘœ ঘটে জরুরি রোগী পরিবহনে। শহরের বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে ও সংযোগ সড়কে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স। অনেক জায়গায় অ্যাম্বুলেন্সগুলোও নিয়মিত গতিতে চলতে পারেনি। সকালে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাও তীব্র দুর্ভোগে পড়েন। অনেক প্রতিষ্ঠান পরীক্ষার সময়সূচি অনুযায়ী ক্লাস ও পরীক্ষা রাখলেও সড়ক অবরোধের তাদের স্কুল পরীক্ষায় যেতে সময় বেশি লেগেছে। অবরোধের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট, দোকানপাট ও ফুটপাথের ব্যবসাসীও ক্ষতিগ্রস্ত হন। ফুটপাথের দোকানিদের অনেকে নির্ধারিত সময়ের পর দোকান খুলতে পারেননি। দিনমজুর, রিকশাচালক ও শ্রমিকদের দিন আয়ের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় অবরোধ তাদের জন্য আরো বড় সঙ্কট সৃষ্টি করে। রিকশাচালকরা জানান, ব্যস্ত রাস্তায় যেতে দিচ্ছে না। অলিগলি দিয়ে ঘুরে মানুষ কোথাও নামতে পারছে না। দায়িত্ব পালনরত মহানগর পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করি। পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়। রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।
রাজধানীর শিক্ষা ভবনের পাশের সংযোগ সড়ক থেকে সচিবালয় অভিমুখী সড়কে অবস্থান নিয়েছেন সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা। এতে হাইকোর্ট মোড় থেকে সচিবালয় অভিমুখে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল সোমবার দুপুর পৌনে একটার দিকে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেন। আন্দোলনকারীরা শিক্ষাভবনের সামনের সড়কে বসে পড়েন। পুলিশ সামনে ব্যারিকেড দিয়ে বাধা তৈরি করে। এতে এই লেন দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে সকাল থেকেই ঢাকা কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা স্ব-স্ব কলেজে বিক্ষোভ মিছিল করেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। আলোচনা সাপেক্ষে পরবর্তী কর্মসূচির সিদ্ধান্ত ঠিক করার কথাও বলছেন তারা। সেøাগানে সেøাগানে তাদের দাবির কথা তুলে ধরছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সাত কলেজ নিয়ে হতে যাওয়া ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’তে স্কুলিং মডেলভিত্তিক খসড়া অধ্যাদেশ উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।
দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানান, শিক্ষা ভবনের সামনে আবদুল গণি সড়কে অবস্থান করেন শিক্ষার্থীরা। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে শিক্ষা ভবনের পেছনের অংশে শিক্ষার্থীদের চলে যেতে বলা হয়। সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজ ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষা ভবন মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। দুপুরে তারা শিক্ষা ভবনের সামনের সড়কের মোড়ে অবস্থান নেন। বিকেলে তারা হাইকোর্ট মোড় অবরোধ করেন। এতে হাইকোর্ট মোড় দিয়ে প্রেসক্লাব, গুলিস্তান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয় অভিমুখী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্ট্রার (এনইআইআর) সংস্কারসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ভবনের সামনে মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীরা অবস্থান নেন। এতে ওই ভবন সংলগ্ন সড়ক ও আশপাশের সড়কগুলোয় দেখা দেয় তীব্র যানজট।
গতকাল রাজধানীর শনির আখড়া এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলা তীব্র গ্যাস সঙ্কটের প্রতিবাদে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীরা। দুপুর ১২টা থেকে শুরু হওয়া এই অবরোধের কারণে মহাসড়কসহ আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে বেলা ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
জানা যায়, আবাসিক বাসা-বাড়িতে দীর্ঘদিন যাবত গ্যাস না থাকায় চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। এরই জেরে দুপুরে তারা রাস্তায় নেমে আসেন এবং শনির আখড়া পয়েন্টে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। দুপুর ১২টা থেকে রাস্তা অবরোধ করে রাখায় মহাসড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়, যা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বেশ কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই অবরোধের প্রভাবে পুরো মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার অচল হয়ে পড়ে এবং যানজট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। দীর্ঘ সময় যানবাহনে আটকা পড়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। পরবর্তীতে বেলা ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন। এরপর থেকে মহাসড়কে যান চলাচল ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য বের হওয়া বেসরকারি চাকরিজীবী বেলায়েত বলেন, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল যেতে সাধারণত ৩০ মিনিট লাগে। কিন্তু দেড় ঘণ্টা ধরে রাস্তায় আটকে আছি। হাঁটতে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি। কথায় কথায় আন্দোলন, এখন মনে হচ্ছে ঢাকা ছেড়ে পালাতে হবে।
সিএনজি চালক আবুল হাশেম জানান, ঢাকার অনেক সড়কে আজকে আন্দোলন চলছে। সড়ক অবরোধ করে রাখার কারণে যাত্রী নিয়ে সব সড়কে যাওয়া যায়না। অর্ধেক রাস্তায় নামিয়ে দিতে হয়। এতে ভাড়াও কম পাই। এভাবে আন্দোলনের কোনও মানে নেই। এমনিতেই ঢাকার সড়কে অনেক জ্যাম থাকে। এরপর এখন যখন-তখন আন্দোলনের নামে সড়ক বন্ধ করে ফেলছে। এতে ভোগান্তিতে পরছি আমরা গরিব মানুষেরা।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, জনবহুল ঢাকায় যানবাহন চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা নেই। তার মধ্যে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তা বন্ধের কারণে খুবই কষ্ট পোহাতে হয়। যাত্রীদেরও ভোগান্তি হয়। বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধের কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করতে খুবই কষ্ট হয়।