কবে নাগাদ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দাঁত ও নখ পুরোপুরি ‘শার্প’ হবে তা বলা কঠিন। তবে দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দাবি, দুর্নীতিবাজদের মধ্যে ভয় তৈরির লক্ষ্যে তারা ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, দুর্নীতি করে আর পার পাওয়া যাবে না- এই বার্তাই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায় কমিশন। কেউ দুদকের ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করলে তাদের নাম প্রকাশ করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংস্থাটির নীতিনির্ধারকরা। বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি এখনও দেশের অন্যতম বড় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ।
প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসটির উদ্দেশ্য হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি এবং রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশেও প্রতি বছর নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের একতা: গড়বে আগামীর শুদ্ধতা’।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ ও সৎ নেতৃত্বের পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধের বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে বাস্তবতায়, বাংলাদেশে দুর্নীতি বহুদিন ধরেই বহুমুখী রূপ নিয়ে সমাজের নানা স্তরে বিরাজমান। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ লোপাট সাধারণ মানুষের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, বড় সরকারি উদ্যোগ এবং সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ছে। এসব কারণে গণতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা দুর্বল হচ্ছে।
গেলো এক বছরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেন দুর্নীতিবাজদের মনোনয়ন না দেওয়া হয়।’
গত ২৫ নভেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, ‘দুদকের দাঁত ও নখ যতটা শার্প হওয়ার কথা ছিল, এখনও ততটা শার্প হয়নি। দুদকের দাঁত ও নখ এখন মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। আশা করি দুদক পূর্ণাঙ্গভাবে শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।’
আগের সরকার ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে দুর্নীতির অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘দুর্নীতি কমেছে নাকি বেড়েছে- এটা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।’ তবে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি যে বন্ধ হয়নি, তা স্পষ্ট।’
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তুলনামূলক বিশ্লেষণের মতো পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এখনও নেই।’
তিনি জানান, দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন মহল দলবাজি, দখলবাজি ও চাঁদাবাজিতে জড়িত।
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সময়ে আরও কঠোরভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু সে ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সাফল্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে টিআইবি একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে।’
দুদকের উপপরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম জানান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কমিশনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে দুদকে মোট ১১ হাজার ৬৩০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৯৬০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ সময়ে ৫ শতাধিক মামলা দায়ের হয়েছে, যাতে দুই হাজারের বেশি আসামি অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
তিনি আরও জানান, দেশে ৩ হাজার ৩৬১ কোটি ২৯ লাখ ৬৭ হাজার ৮৯১ টাকার সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে। বিদেশে ক্রোক করা সম্পদের পরিমাণ ৯৬ কোটি ৫৩ লাখ ৮০ হাজার ২৫ টাকা। বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব থেকে দেশে ২২ হাজার ২২৬ কোটি ৭৯ লাখ ৩২ হাজার ৬০৬ টাকা জব্দ করা হয়েছে। বিদেশে জব্দ করা হয়েছে ৩২৮ কোটি ১১ লাখ ১২ হাজার ৬৭৪ টাকা এবং ২৪ হাজার ৭৯০ মার্কিন ডলার। জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৩টি গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজকের দুদকের কর্মসূচি
দুদক কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানান, ‘দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে দুদক দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সকাল সাড়ে ৮টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন, জাতীয় পতাকা ও দুদকের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে কর্মসূচি শুরু হবে। সকাল ৯টায় দুদক প্রধান কার্যালয়ের সামনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১০টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা অডিটোরিয়ামে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং বিশেষ অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর মহাপরিচালক ড. এ কে এনামূল হক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। একইসঙ্গে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও দিবসটি যথাযথভাবে উদযাপিত হবে।