জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত ৬ জনকে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামি পক্ষের দুজন সাক্ষী ডিফেন্স উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এদিন মামলার আসামি শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক আরশাদ হোসেন সাক্ষ্য দেয়ার সময় কিছুটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করলে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ আরশাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি যে স্টাইলে কথা বলছেন, ঐখানে কী করেছেন- এটা বুঝা যাচ্ছে। আপনি কোর্টে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি তো কোর্টের পরিবেশ নষ্ট করছেন। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যে বেয়াদবি করছে, এটি তো ঝগড়া করার বিষয় নয়।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্যগ্রহণ নেয়া হয়। দুপুরের বিরতির পরে বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদের নেতৃত্বে একক ট্রাইব্যুনাল বেঞ্চে এ সাক্ষীর আংশিক সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। তবে এসময় ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার ও অপর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী অনুপস্থিত ছিলেন।
মামলার আসামি ও সাক্ষী সাবেক পরিদর্শক আরশাদ হোসেন বলেন, ২০১১ সালে এসআই হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। ২০২২ সালে ইন্সপেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০২৩ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর শাহবাগ থানায় ইন্সপেক্টর (অপারেশন) হিসেবে যোগদান করি এবং গত বছরের ১৮ই আগস্ট পর্যন্ত শাহবাগ থানায় কর্মরত ছিলাম। পরবর্তীতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আমাকে ক্লোজ করা হয়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সরকারি আদেশ- নির্দেশ মোতাবেক দায়িত্ব পালন করি। আমি শাহবাগ থানার এসআই, এএসআই ও কনস্টেবলদের ডিউটি বণ্টন করি এবং বাইরে থেকে আসা পুলিশের সকল ফোর্সদের বিভিন্ন পয়েন্টে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মোতায়েনের ব্যবস্থা করি। শাহবাগসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি পয়েন্টে প্রত্যেক দিন অফিসার এবং ফোর্স সঠিক সময়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৩১শে জুলাই ২০২৪ রোজ বুধবার “মার্চ ফর জাস্টিস” ছাত্রদের প্রোগ্রামে হাইকোর্টের মাজার গেইটের সামনে অবস্থান নিলে চারদিক থেকে আন্দোলনকারীরা সরকারবিরোধী স্লোগান ও পুলিশের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, এসময় প্রেস ক্লাব ও শিক্ষা ভবনের দিক থেকে দু’টি মিছিল মাজার গেটের দিকে আসতে থাকে। তখন এসি ইমরুল স্যার এবং আমি ফোর্স নিয়ে তাদের বাধা দিলে তারা থেমে যায়। কিন্তু প্রেস ক্লাবের দিক থেকে আসা মিছিলটি আমাদের বাধা উপেক্ষা করে হাইকোর্টের গেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে “ফুটফুটে সুন্দর আসছে”। কয়েকজন মেয়ে আমাকে লক্ষ্য করে মাটির দিকে থুতু নিক্ষেপ করে। তাতে আমরা উত্তেজিত হয়ে যাই এবং দুজন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করি। তারা প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে তাদের পরিচয় দেয়। পরে বলে খিলগাঁও মডেল কলেজের ছাত্র। আমি বলি মিথ্যা কথা বলছো কেন? তখন সে উত্তেজিত হয়ে জোরে জোরে কথা বলতে থাকলে আমি তখন আমার বাম হাত উঁচিয়ে তাকে চুপ থাকতে বলি এবং তাকে তার বেল্ট ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠাই। পরে জানতে পারি তার নাম নাহিদ। মাজার গেটের সামনে আসলে আরও কিছু আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রী আমার ইউনিফর্ম ধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে আমাকে পেছনের দিকে নিয়ে যায়। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়। ট্রাইব্যুনালের জিজ্ঞাসাবাদে এই সাক্ষী জানান যে, ভিডিওটি তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল “বার্তা বাজার” থেকে সংগ্রহ করেছেন। তখন বিএনপি নেতা এডভোকেট মাহাবুব উদ্দিন খোকন সাহেব এসে অনুরোধ করলে আমি ডিসি স্যারকে বলে ঐ ছাত্রসহ আটককৃত দুজনকে ছেড়ে দেই। তখন বিভিন্ন চিত্রের অংশবিশেষ কেটে এডিট করা একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়। যার ফলে আমি মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই। তখন আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলে যে, আপনার শাহবাগ ছাড়া অন্য কোথাও ডিউটি করার দরকার নাই।
তিনি বলেন, ৫ই আগস্ট ছাত্র আন্দোলন চরমপর্যায়ে পৌঁছালে সরকার কারফিউ জারি করেন। তখন সেনাবাহিনী এসে শাহবাগ মোড় থেকে সকল পুলিশকে সরে যেতে বললে আমি থানায় চলে আসি এবং আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানালে এডিসি আক্তার স্যার আমাকে দ্রুত চানখাঁরপুলে গিয়ে রিপোর্ট করতে বলে। আমি প্রথমে শহীদুল্লাহ হল ক্রসিং চেকপোস্টে আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১টায় যাই। সেখান থেকে চানখাঁরপুলে এডিসি আক্তার স্যারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রচুর সাউন্ড গ্রেনেড, গুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের কারণে আমি সেখানে যেতে পারি নাই। এর অল্প কিছুক্ষণ পর এডিসি আক্তার স্যারের সঙ্গে দেখা করি এবং শাহবাগ সম্পর্কে তাকে বিভিন্ন তথ্য দেই। তখন তিনি আমাকে চানখাঁরপুলস্থ শহীদুল্লাহ হল ক্রসিং চেকপোস্টের সামনে পুলিশের সঙ্গে অবস্থান করতে বললে আমি সেখানে অবস্থান করি। বেলা ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে আনুমানিক ৩০০/৪০০ ছাত্র-জনতা স্লোগান দিতে থাকে। আন্দোলনকারীদের দুজন আমার পরিচিত হওয়ায় তারা আমার কাছে এসে বলে আপনারা চলে যান, সরকার পতন হয়ে গেছে। বেলা সোয়া ১২টায় এডিসি আক্তার স্যারকে বিষয়টি জানিয়ে তার অনুমতিক্রমে আমরা সকলে থানায় চলে যাই। ঐ দিন আমি চানখাঁরপুলে কোনো অস্ত্র ব্যবহার করি নাই। কাউকে গুলি করি নাই এবং কাউকে খুন বা আহত করি নাই। কাউকে গুলি করার নির্দেশ দেই নাই। কাউকে গুলি করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করি নাই। আমি আইন অনুযায়ী আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আন্দোলনকারী ছাত্ররা আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা সত্ত্বেও আমি কোনো প্রকার বলপ্রয়োগ করা থেকে বিরত থেকেছি।
সাক্ষীর জেরা: সাক্ষী আরশাদকে জেরা করার সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম তাকে প্রশ্ন করেন, এ যে ভিডিও ফুটেজটি দেখালেন এটি কে ধারণ করেছে, এটি এডিট করা হয়েছে কিনা। এই ভিডিওটি যে ধারণ করেছে তাকে মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে কিনা। জবাবে না-সূচক উত্তর দেন আরশাদ। এ সময় মিজানুল বলেন, এই ভিডিও ধারণের কিছুক্ষণ পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আপনাকে কি বলেছিল, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুখ চেপে ধরার সাহস কী করে হয়। জবাবে আরশাদ বলেন, এটি সত্য নয়। মিজানুল বলেন, গত বছরের ১৪ই জুলাই ও ১৫ই জুলাই পুলিশের উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের উপর যে হামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কিনা। জবাবে আরশাদ বলেন, আমি সেখানে ছিলাম না, এ বিষয়ে আমার জানা নাই। প্রসিকিউটর মিজানুল বলেন, যে ১৬টা পয়েন্টে ফোর্স পাঠিয়েছিলেন, তাদের ফিরতি জিডি পর্যালোচনা করেছেন কিনা। আরশাদ বলেন, জিডি পর্যালোচনার দায়িত্ব আমার নয়, এটি ওসি করবেন। এসময় আরশাদ কিছুটা গরম সুরে মিজানুলের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি যে ভাবে প্রশ্ন করছেন, আইন দেখেন, এটি আমার এখতিয়ারের বাইরে। ফোর্স মোতায়েন হলে পরে তাদের ডিউটি শেষ হলে ওয়্যারলেসে বলা হয় আপনাদের ডিউটি শেষ। তখন প্রসিকিউটর বলেন, আমি প্রটেকশন চাচ্ছি। উনি এখন আমাকে ট্রেনিং দিবেন। এ সময় বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ আরশাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি যে স্টাইলে কথা বলছেন, ঐখানে কি করেছেন এটা বুঝা যাচ্ছে। তখন মিজানুল বলেন, শাহবাগ থানায় সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার হিসেবে আপনি দায়িত্বে ছিলেন। ৫ই আগস্ট চানখাঁরপুলে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আপনি জিডি করেছিলেন কিনা। জবাবে আরশাদ বলেন- এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আমার জানা নাই। তখন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ আরশাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ডকে দাঁড়িয়ে সত্য বলছেন কিনা। জবাবে হ্যাঁ বলেন তিনি। পরে মিজানুল বলেন, আন্দোলনের পরেও ৫ মাস আপনি চাকরিতে ছিলেন, আপনার কর্মকাণ্ড নিয়ে অনলাইন কিংবা অফলাইনে কোনো জিডি করেছেন। এ সময় উত্তেজিত হয়ে জবাব দেন আরশাদ; তখন বিচারপতি শফিউল আলম আরশাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি এত বেশি কথা বলেন কেন? আপনি কোর্টে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি তো কোর্টের পরিবেশ নষ্ট করছেন। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বেয়াদবি করছে, এটি তো ঝগড়া করার বিষয় নয়।