Image description

খুন, ছিনতাই, ধর্ষণ, অপহরণ। বছর জুড়ে রীতিমতো আতঙ্ক-উদ্বেগ তৈরি করেছে জনমনে। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই দেখা যাচ্ছে কারও না কারও পোস্ট। বিশেষ করে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেন ভুক্তভোগীরা। দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কোপানোর ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঘটছে প্রকাশ্যে বীভৎস খুনের ঘটনা। চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ‘ধর্ষণের’ ঘটনায় বেড়েছে উদ্বেগ। প্রকাশ্যে গণপরিবহনে হেনস্তার শিকার হচ্ছে নারীরা। ঢাকায় খুন হয়েছে বিদেশি নাগরিক। মব সন্ত্রাসে হত্যা করা হয়েছে মানুষ। সবমিলিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় মানুষ। আবার কোথাও কোথাও অপরাধ দমাতে গেলে হামলার শিকার হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে অপরাধের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়তি ছিল। বর্তমান সময়ে অপরাধ কমে এলেও প্রতিনিয়ত ভয়ঙ্কর ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সামনে রয়েছে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। অপরাধ মোকাবিলায় পুলিশের সক্রিয়তা আরও বেশি জরুরি। আরও বেশি কঠোর হতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। 

পুলিশের হিসাব মতে, গত ১১ মাসে সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫০৫টি। এসব মামলার বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে- ছিনতাই, অপহরণ, ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন ও দস্যুতার মতো ঘটনা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে। খুনও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে অপরাধের মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৭২টি ও ফেব্রুয়ারিতে ১৩ হাজার ২টি। মার্চে ১৬ হাজার ২৪০টি। এপ্রিলে ১৬ হাজার ৩৬৮টি। মে মাসে ১৬ হাজার ৪৫টি। জুন মাসে ১৫ হাজার ১৬৭টি। জুলাই মাসে ১৫ হাজার ৩৮৯টি। আগস্টে ১৫ হাজার ৬৫৬টি। সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার ৪৩১টি। অক্টোবরে ১৬ হাজার ১৭০টি ও নভেম্বরে ১৪ হাজার ৪৬৫টি। চলতি বছর দেশে এই ১১ মাসে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণ, পুলিশের ওপর হামলা, চুরি, সিঁধল চুরিসহ অন্যান্য অপরাধে মোট মামলা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫০৫টি। ২০২৪ সালে দেশে মোট অপরাধে মামলার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭২ হাজার ৫টি এবং ২০২৩ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৩৬টি। পুলিশের তথ্যমতে, সারা দেশের এসব মামলার বিশ্লেষণে দেখা গেছে ডাকাতি, ছিনতাই, দস্যুতা খুন, অপহরণ ও নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ১১ মাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৫৭৮টি, দস্যুতা ১ হাজার ৮০৩টি, খুন ৩ হাজার ৫০৯টি, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা ২০ হাজার ৬৯১টি, অপহরণ ১ হাজার ১৪টি, পুলিশের ওপর হামলা ৫৭২টি, সিঁধল চুরি ২ হাজার ৮১৯টি, চুরি ৯ হাজার ৪টি ও অন্যান্য মামলা ৭৫ হাজার ৮৬১টি। ১১ মাসে বিভিন্ন অপরাধে ঢাকায় মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৫০২টি।

জবি শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা: চলতি বছরের ১৯শে অক্টোবর পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) জুবায়েদ হোসাইন নামে এক শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ঘটনার দিন টিউশনিতে যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মামলায় সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিহত জুবায়েদ হোসাইন পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনা উপজেলায়। তিনি জবিস্থ কুমিল্লা জেলা ছাত্রকল্যাণ সমিতির সভাপতি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সদস্য ছিলেন। 

চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ‘ধর্ষণ’: ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতি ও দুই নারী যাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসটি ছাড়ার কিছু সময় পরেই আট থেকে দশজন ডাকাত চাকু, ছুরি ও পিস্তল নিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করে। এ সময় তারা দুই নারীকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ করেছেন ওই বাসের যাত্রীরা। বাসের চালক ও তার সহযোগীরা ডাকাতদের সহায়তা করেছেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বাসের চালক, সুপারভাইজার ও সহকারীকে গ্রেপ্তার করে নাটোরের পুলিশ। বড়াইগ্রাম থানার মোড় এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রকাশ্যে এলোপাতাড়ি গুলি করে খুন: চলতি বছরের ১৭ই নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরে দোকানে ঢুকে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়া (৪৭)কে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এদিন সন্ধ্যায় মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের সি ব্লকে এ ঘটনা ঘটে। এরপর দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যাওয়ার সময় আরিফ হোসেন নামে ব্যাটারিচালিত এক অটোরিকশাচালককে গুলি করে।

ব্যবসায়ীকে পাথর মেরে হত্যা: ৯ই জুলাই রাজধানীর পুরান ঢাকায় লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগ (৩৯) নামে এক ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও পাথর খণ্ড দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের তিন নম্বর গেটসংলগ্ন রজনী ঘোষ লেনে এ ঘটনা ঘটে। লোমহর্ষক এ ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের মধ্যে তৈরি হয় আতঙ্ক।

মব সন্ত্রাসে ১০ মাসে নিহত ১৪০: দেশে মব সহিংসতা ও গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে এসব ঘটনায় ১৪০ জন নিহত হয়েছে, যা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক যুগে এ ধরনের ঘটনায় সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মব সহিংসতা ও গণপিটুনির অন্তত ২৫৬টি ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ২৩১ জন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০২৩ সালে এ ধরনের ঘটনায় ৫১ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৪ সালে এমন ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১২৮ জনের। এইচআরএসএস বলছে, মব সহিংসতা ও গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জানুয়ারি-অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক এইচআরএসএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ মাসে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ২৩১ জন।

মারামারি-সংঘর্ষে ৯৯৯-এ ১০ মাসে ৭৯২৩৯ কল: নানা বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ দিনে ফোন আসে ২৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে নারী নির্যাতন, দুর্ঘটনা, মারামারি-সংঘর্ষ, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, অগ্নিকাণ্ড, বাল্যবিয়ের অভিযোগে কল আসে। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত ১০ মাসে মারামারি-সংঘর্ষের ঘটনায় কল আসে ৭৯ হাজার ২৩৯টি। গত ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়ে ৯৮৮ জন, ধর্ষণ চেষ্টাকালীন ফোন কল ৫৫৭টি, যৌন হয়রানি ও সহিংসতায় ৯৮৭ জন, অন্যান্য সহিংসতার ঘটনায় ৪০১ জন, অপহরণে ৪৬ জন, আত্মহত্যার প্ররোচনায় ১০ জন, বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে ৩৬০ জন, হত্যার শিকার ৬৪৭ জন, ইভটিজিংয়ের শিকার ৭৯৩ জন, স্বামী দ্বারা অত্যাচারিত ১৪ হাজার ৯২৮ জন, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার ৩১৬ জন, মা-বাবার নির্যাতনের শিকার ৪৬৫ জন, এসিড সন্ত্রাসের শিকার ৯ জন ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হয়ে ৫ হাজার ৮১০ জন নারী ফোন দিয়ে সেবা নিয়েছেন।

লুট হওয়া ১৩৪০ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি: পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালিয়ে ৫ হাজার ৭৬৩টি অস্ত্র লুট করা হয়েছিল। লুট হওয়া এসব অস্ত্রের মধ্যে ৪ হাজার ৪২৩টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এখনো উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৩৪০টি অস্ত্র। এসব অস্ত্রের বেশির ভাগই রয়েছে অপরাধীদের হাতে।

সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, এ সকল অপরাধকে দমাতে প্রতিরোধ-প্রতিকার জরুরি। যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, সেগুলোকে তদন্ত করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। অস্ত্র লুট হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের বিষয়। জননিরাপত্তা রক্ষায় দ্রুত এসব অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিতে হবে এবং অভিযান চলমান রাখতে হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময় অপরাধ প্রবণতা, ডাকাতি, অপহরণ, সহিংসতা, সংঘাত, খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ- এই ধরনের অপরাধগুলো অনেক কমে আসার কথা। এটাই আমরা প্রত্যাশা করেছি কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত। দেশে একটি চক্র তৈরি হয়েছে যারা অপরাধটি তার আয়-উপাজর্নের উৎস মনে করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক থাকা, তাদের টহল কার্যক্রম বাড়ানো, অভিযুক্তদের দ্রুততার সঙ্গে গ্রেপ্তার করে সাজার আওতায় নিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ। 

আইনজীবী কে এম মাহফুজ মিশু মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ঘটছে। এটি নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিকে কোনো না কোনো ঘটনা ঘটছে। যে সকল অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের আদালতে পাঠানোর পর তারা যেন জামিন না পায়- সেই বিষয়ে কোনো আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের একটু সজাগ থাকা উচিত। অপরাধের তুলনায় অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উন্নতি এবং যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে- তারা যেন কোনোভাবেই জামিন না পায়।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, দেশে সব ধরনের অপরাধ দমাতে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। সেইসঙ্গে বাড়ানো হয়েছে পুলিশি টহল। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা আরও বেশি সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।