কর্মী নিয়োগের জন্য মালয়েশিয়ার সরকারের দেওয়া ১০টি শর্তের মধ্যে চারটি শর্ত শিথিল করে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে আবেদন নিয়েছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চারটি ছাড়া বাকি শর্ত পূরণ করে এমন প্রায় ৪০০ রিক্রুটিং এজেন্সি আবেদন করেছে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতে। এর মধ্যে ২৭১টি রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাকি আবেদন বাতিল হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে জানা যায়, এর মধ্যে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিও প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করেছে।
অপরদিকে অন্য তিন শর্ত বাদ দিতে মালয়েশিয়ার সরকারকে চিঠি দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। মালয়েশিয়ার দেওয়া শর্ত নিয়ে অন্যান্য দেশ কোনও সিদ্ধান্ত না নিলেও বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে।
বিদ্যমান সমঝোতার আওতায় সম্প্রতি কর্মী নিতে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যার বিষয়ে নতুন করে ভাবছে দেশটি। তাই তথ্য চেয়ে গত মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, মিয়ানমার থেকে কর্মী নিতে শর্তসহ এসব দেশের দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে মালয়েশিয়ার সরকার। চিঠিতে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্লেখ করে, ‘মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ ও কাজে নিয়োগের সুবিধার্থে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা যৌক্তিক করতে সম্মত হয়েছে। এই যৌক্তিকতা ১০টি বাধ্যতামূলক মানদণ্ড অনুসারে মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত সুনির্দিষ্ট এবং যোগ্যতাভিত্তিক যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।’
মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শর্ত অনুযায়ী আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে তালিকা সে দেশের মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠাতে অনুরোধ করেছে। মালয়েশিয়া সরকার বলছে, তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী এজেন্সির নাম দিতে হবে। শর্ত পূরণ না করলে কর্মী নিয়োগের জন্য তাদের বিবেচনা করা হবে না। আরও বলা হয়েছে—এই নীতি দুই দেশের মধ্যে গঠনমূলক এবং নৈতিক শ্রম অভিবাসন অনুশীলনকে শক্তিশালী করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
মালয়েশিয়ার দেওয়া ১০টি শর্তে কী আছে?
মালয়েশিয়া সরকারের দেওয়া শর্তের মধ্যে আছে— ন্যূনতম পাঁচ বছর ধরে কর্মী পাঠিয়েছে এমন এজেন্সি, গত পাঁচ বছরে অন্তত ৩ হাজার কর্মী পাঠিয়েছে, অন্তত তিনটি দেশে গত পাঁচ বছরে কর্মী পাঠিয়েছে, উৎস দেশে কর্মী পাঠাতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের লাইসেন্স আছে, গন্তব্য দেশের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভালো কাজের স্বীকৃতি আছে, জোরপূর্বক শ্রম, মানবপাচার, শ্রম আইন লঙ্ঘন, জোরপূর্বক অর্থ আদায়, মানিলন্ডারিংসহ অন্যান্য আর্থিক অপরাধে সংশ্লিষ্ট নয়, সব ধরনের সুবিধাসহ নিজস্ব প্রশিক্ষণ সুবিধা আছে, পাঁচটি আন্তর্জাতিক নিয়োগকর্তার কাছ থেকে প্রশংসাপত্র, অন্তত ১০ হাজার স্কয়ার ফিটের নিজস্ব অফিস আছে এবং মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে বৈধভাবে ও সঠিক প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রমাণপত্র থাকতে হবে।
তবে মালয়েশিয়ার দেওয়া শর্ত অনেক রিক্রুটিং এজেন্সির পূরণ করার সক্ষমতা নেই বলে এ নিয়ে আপত্তি তুলেছেন অনেকেই।
চার শর্ত এড়িয়ে প্রত্যয়নপত্র নেওয়ার নির্দেশ মন্ত্রণালয়ের
মালয়েশিয়ার চিঠি পাওয়ার পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর রিক্রুটিং এজেন্সিদের কাছ থেকে তালিকা আহ্বান করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এরপর কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি এবং জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাবেক কয়েকজন নেতা নতুন করে ‘সিন্ডিকেট’ হওয়ার আশঙ্কায় চিঠি দেয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বরাবর। চিঠি দেওয়ার পর ৩ নভেম্বর ওই নেতাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন উপদেষ্টা। বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম জানান, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর জন্য রিক্রুটিং এজেন্সির যে ১০টি ক্রাইটেরিয়া দেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ক্রাইটেরিয়াগুলো অবাস্তব, অপ্রয়োজনীয় ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুনরায় সিন্ডিকেট বাস্তবায়ন করার নীলনকশা হিসেবে উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরা হয়।
বায়রার নেতারা উপদেষ্টাকে জানান, আপাতদৃষ্টিতে শর্তগুলো ভালো মনে হলেও বাস্তবে পূরণ করা সম্ভব না। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে ৯৯ শতাংশ রিক্রুটিং এজেন্সি বাদ পড়ে যাবে। আর তাতে সিন্ডিকেট তৈরি হবে।
এরপর গত ৪ নভেম্বর জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোকে চিঠি দেয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে আগ্রহী নির্ধারিত ক্রাইটেরিয়া পূরণকারী রিক্রুটিং এজেন্টদের আগামী ৭ নভেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। বর্ণিত বিজ্ঞপ্তির ১, ২, ৩, ৫, ৭ ও ৯নং মানদণ্ডের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে রিক্রুটিং এজেন্সির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করা প্রয়োজন। এমতাবস্থায়, মহাপরিচালক, বিএমইটিকে এজেন্সিগুলোকে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে আবেদনকারী রিক্রুটিং এজেন্সির অনুকূলে প্রয়োজনীয় প্রত্যয়নপত্র প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
যে চারটি শর্ত বাদ দিয়ে প্রত্যয়নপত্র দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- নিজ দেশে কর্মী পাঠাতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের লাইসেন্স আছে, জোরপূর্বক শ্রম, মানবপাচার, শ্রম আইন লঙ্ঘন, জোরপূর্বক অর্থ আদায়, মানিলন্ডারিংসহ অন্যান্য আর্থিক অপরাধে সংশ্লিষ্ট নয়, পাঁচটি আন্তর্জাতিক নিয়োগকর্তার কাছ থেকে প্রশংসাপত্র এবং মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে বৈধভাবে এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রমাণপত্র থাকতে হবে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে, ওই শর্ত অন্তর্ভুক্ত না করে আবেদন গ্রহণ করে প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করেছে বিএমইটি। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, অভিযোগ থাকলেও তাদেরও প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে বিএমইটি’র একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নামে প্রত্যয়নপত্র
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী যেসব রিক্রুটিং এজেন্সিকে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে অনেকেরই বিরুদ্ধে মানবপাচার ও মানিলন্ডারিং মামলা আছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলাতেও অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিকেও প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করা হয়েছে। পাশাপাশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে। প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করা রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে অনেকেই বিগত সময় মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে জড়িত ছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট করার অভিযোগ আছে। প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করা হয়েছে এমন এবং অভিযোগ আছে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে – দাহামাসি কর্পোরেশন, ইউনিক ইস্টার্ন লিমিটেড, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, নাভিরা লিমিটেড, ত্রিবেণী ইন্টারন্যাশনাল, মুবিন এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, আল রাবেতা ইন্টারন্যাশনাল, আদিব এয়ার ট্রাভেলস, জেজি আলফালাহ ম্যানেজমেন্ট, গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজ, প্রান্তিক ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম লিমিটেড, ফোর সাইট ইন্টারন্যাশনাল, আমিন ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস, মালয়েশিয়া বাংলাদেশ হোল্ডিং লি., অরবিটালস ইন্টারন্যাশনাল, ইস্টওয়েস্ট প্যারাডাইস, সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল, বিনিময় ইন্টারন্যাশনালসহ আরও বেশ কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএমইটি থেকে প্রাপ্ত তালিকা মন্ত্রণালয় পুনরায় দেখবে, তারপর সেটি দূতাবাসের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’
তিনটি শর্ত শিথিলে মালয়েশিয়াকে চিঠি
এদিকে মালয়েশিয়ার দেওয়া ১০টি শর্তের মধ্যে তিনটি শর্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে মালয়েশিয়ায় চিঠি দিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। চিঠিতে গত পাঁচ বছরে কমপক্ষে ৩ হাজার বিদেশি কর্মী পরিচালনা করা, একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র থাকা এবং গত তিন বছর ধরে কমপক্ষে ১০ হাজার বর্গফুট স্থায়ী অফিস স্পেস বজায় রাখার শর্ত থেকে শিথিল করার জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ করেছে। এছাড়া রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠানোর সময়সীমা বাড়ানোর জন্য মালয়েশিয়াকে অনুরোধ জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
১০ শর্ত মানতে পারছে না নেপাল
মালয়েশিয়া সরকারের কাছে পাঠানো চিঠির জবাব দিয়েছেন নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী সুশিলা কারকি, যিনি একইসঙ্গে শ্রম মন্ত্রণালয়ও দেখছেন। সম্প্রতি তিনি চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, বর্তমান সাংবিধানিক বিধান, সরকার গৃহীত শ্রম ও অভিবাসন নীতি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান সংক্রান্ত আইন, নেপাল ও মালয়েশিয়ার মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় শ্রম চুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নেপালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও শ্রম প্রশাসনের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করা হচ্ছে। নেপালি শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়া একটি প্রধান ও আকর্ষণীয় শ্রম গন্তব্য হওয়ার প্রেক্ষাপটে এই মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিভঙ্গি যে নেপালি সরকার মালয়েশিয়া সরকার উল্লিখিত শর্ত ও মানগুলো গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারবে না এবং মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে শ্রম সম্পর্কিত বিষয়গুলো পরিচালনা করা যেতে পারে। এই বিষয়ে, অনুরোধ করা হচ্ছে যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে মালয়েশিয়া সরকারকে তথ্য পাঠানো হোক, যার মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত পরামর্শ এবং প্রতিক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যাতে নেপালি শ্রমিকদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা যায়।