গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনার রায়ের তারিখ ঘোষণা ঘিরে দেশ জুড়ে নাশকতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। ১৩ই নভেম্বর রায়ের দিন ধার্য করার খবরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রায় প্রতিহত করার মিশনে নেমেছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাদের তরফে ওইদিন সারা দেশে লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দলটির পলাতক সিনিয়র নেতারাও এ নিয়ে তৎপরতা শুরু করেছেন। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও লকডাউন বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, রায়ের সিদ্ধান্ত আটকে দেয়ার অংশ হিসেবে দলটির নেতাকর্মীরা নাশকতা, অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ, ঝটিকা মিছিল করার চেষ্টা করতে পারে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের ভিডিও বার্তায় লকডাউনের ঘোষণার পর থেকে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আওয়ামী লীগের ‘নাশকতার’ কোনো পরিকল্পনা থাকলে তা ঠেকাতে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বার্তা দেয়া হয়েছে সারা দেশের পুলিশকে। থানায় থানায় দেয়া হয়েছে কড়া বার্তা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যাতে ঘর থেকে বের হতে না পারে সেজন্য থানা পুলিশকে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে।
পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের লকডাউনের বার্তা আসার পর থেকে নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ। রেঞ্জ ও এসপি কার্যালয় থেকে থানার ওসিদের কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বার্তার পর থেকে সব থানা এলাকায় পুলিশ তৎপরতা ও নজরদারি বাড়িয়েছে। এলাকাভিত্তিক নেতাকর্মীদের তালিকা করে তাদের অবস্থান শনাক্তসহ কে কোথায় কি করছে সেসব খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ১০ই নভেম্বর থেকে পরবর্তী সময়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে মাঠে অবস্থান করবে পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ইতিমধ্যে নাশকতা বাস্তবায়নের পথেই হাঁটছে। ইতিমধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফ স্কুলে গত শনিবার রাতে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় স্কুল কর্তৃপক্ষ থানায় জিডি করেছে। তবে কে বা কারা স্কুলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সেটি এখনো জানা যায়নি। পুলিশ এখনো কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি। জিডিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ বলেছে, শুক্রবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে বিদ্যুৎ ছিল না। ঠিক সেই সময় ৩ নম্বর ফটকের বাইরে থেকে একটি ককটেল ভেতরে ছুড়ে মারা হয়। এতে বিস্ফোরণ হয়। কেউ হতাহত হয়নি। কে বা কারা ককটেল ছুড়েছে, সেটি তারা দেখেনি। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী রফিক আহমেদ জানান, কে বা কারা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে এখনো শনাক্ত করা যায়নি। ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একটি জিডি করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এর আগে গত শুক্রবার রাত পৌনে ১১টার দিকে রাজধানী রমনার কাকরাইল এলাকায় অবস্থিত সেন্ট মেরি’স ক্যাথেড্রাল গির্জায়ও দুটি ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি ককটেল বিস্ফোরিত হলেও আরেকটি অবিস্ফোরিত থেকে যায়। পরে পুলিশ এসে সেটি নিষ্ক্রিয় করে। এ ঘটনায়ও কেউ হতাহত হয়নি বলে পুলিশ জানিয়েছে।
ওদিকে শনিবার রাত ২ টা ৫০ মিনিটের দিকে মিরপুর-২ নম্বর এলাকায় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বাসে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুই ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। একাধিক সূত্র বলছে, ছোট ছোট ঘটনার মধ্যদিয়ে দুর্বৃত্তরা আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে। স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ককটেল বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ভালো আলামত নয়। নাশকতার উদ্দেশ্য ছাড়া শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটে না। এই থেকে বড় হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে, নাশকতা, স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে পুলিশ, র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। সোমবার থেকে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে কড়াকড়ি শুরু হবে। ঢাকার বাহিরে থেকে কারা ঢুকছে খোঁজখবর নিবে পুলিশ। গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হবে। যানবাহন তল্লাশি করা হবে। পুলিশের পাশাপাশি, র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেকপোস্ট বসাবে। কিছুদিন হোটেল-মোটেলে কারা অবস্থান করছে সেসব তথ্য সংগ্রহ করবে পুলিশ। সন্দেহভাজন কাউকে পেলেই গ্রেপ্তার করা হবে। এ ছাড়া দেশ জুড়ে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ঢাকায় যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য ডিএমপি’র সকল ইউনিটকে কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া থানা পুলিশ মহড়া দেয়াসহ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ তালিকা ধরে নিষিদ্ধ সংগঠনটির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও খোঁজখবর নিচ্ছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ দলটির নেতাকর্মীরা দেশের বাইরে অবস্থান করায় তাদের সমস্ত কার্যক্রম মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পরিচালনা করছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের এসব বার্তা বিভিন্ন পেজ থেকে শেয়ার হচ্ছে। কারা এসব পেজ ও গ্রুপ পরিচালনা করছে, দেশের ভেতর থেকে কারা গোপনে এসব গ্রুপের বার্তা ও পেজ শেয়ার করছে তাদের বিষয়েও সাইবার টিম নজরদারি করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক থানার ওসি মানবজমিনকে বলেন, আওয়ামী লীগের লকডাউনের বিষয়টি গুজব হোক আর সত্যি হোক আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমরা ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশনামতো কাজ করছি। যে এলাকায় কোনো ঘটনা ঘটবে সেই থানার ওসির ওপর দিয়েই চাপটা যাবে। তাই আগামী কিছুদিন সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে থানা পুলিশ। এ নিয়ে আমাদের কড়া বার্তা দেয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, কোনো ধরনের হুমকি-ধমকি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করা যাবে না। পতিত আওয়ামী লীগের সাবেক এই শীর্ষ নেত্রীর মামলার রায়কে ঘিরে কোনো নিরাপত্তা শঙ্কা নেই। এ ছাড়াও আইনশৃক্ষলা বাহিনীর সদস্যরা বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।
সুপ্রিম কোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল কোর্ট সিকিউরিটি বিভাগের ডিসি মো. জসিম উদ্দীন মানবজমিনকে বলেন, রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট হুমকির তথ্য কিংবা কোনো নিরাপত্তা শঙ্কা নেই। তবে, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ সতর্ক থাকবে। এ ছাড়াও সাদা পোশাকেও গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত থাকবে।
র্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, এগুলো উড়ো খবর। কনফার্ম কিছু না। গুজবে কান দেয়ার কোনো সুযোগ নাই। দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই র্যাবের গোয়েন্দা টিম ও সাইবার মনিটরিং টিম সব সময় তৎপর রয়েছে। এ ধরনের উড়ো খবর যখন আসে তখন আমাদের টিম আরও বেশি তৎপর হয়ে কাজ শুরু করে। এই ইস্যুকে ঘিরেও মনিটরিং শুরু হয়েছে। যেকোনো ধরনের তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছে আমাদের টিম।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, বিভিন্ন পেজ ও আইডি থেকে এই ধরনের তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এগুলো দেশের বাহিরে থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে তথ্য যাই হোক আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবো। কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটির কোনো কার্যক্রম করার সুযোগ নাই। আমরা আইনি ব্যবস্থা নেবো। আগেও আমরা অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছি। আর চলমান ইস্যু নিয়ে আমরা তৎপরতা বাড়িয়েছি। আমাদের সাইবার টিমও এ নিয়ে কাজ করছে।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক মানবজমিনকে বলেন, ঢাকা রেঞ্জের প্রতিটি জেলায় নির্দেশনা দিয়েছি। আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী কোনো ধরনের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তারা আগেও অনেক ধরনের হুমকি দিয়েছে, এখনো দিয়ে যাচ্ছে। ১৩ই নভেম্বর ঘিরে তারা মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে আলোচনায় আসতে চাইছে। তাদের আমরা সেই সুযোগ দেবো না।
পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) রেজাউল করিম মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কোনো বিশৃঙ্খলা করার সুযোগ নাই। আওয়ামী লীগকে কোনোভাবে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না।