Image description

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’র। উপদেষ্টা পদ ছেড়ে আসিফ দলের কোন পদে আসবেন- এ নিয়েই মূলত টানাপড়েনের শুরু। দলীয় পদ নিশ্চিত করে সরকার থেকে পদত্যাগ করতে চান আসিফ মাহমুদ। অন্যদিকে এনসিপিও উপদেষ্টা আসিফের প্রত্যাশিত পদ দিতে রাজি নয়।

এনসিপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন, জাতীয় ছাত্রশক্তি ও জাতীয় যুবশক্তিতে থাকা আসিফের অনুসারীরা চাইছেন আসিফকে যেন দলের ‘মুখ্য সমন্বয়কারী’ পদ দেয়া হয়। এ পদে এখন দায়িত্ব পালন করছেন পার্টির সাবেক আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। যিনি এনসিপি’র নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধানসহ স্ট্র্যাটেজিক লিডার হিসেবে কাজ করছেন। মুখ্য সমন্বয়কের পদ না পেয়ে আসিফ মাহমুদ সক্রিয় করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের কমিটি। স্থগিত হওয়া এই কমিটিকে সক্রিয় করায় এনসিপি ও জাতীয় ছাত্রশক্তির মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। গুঞ্জন রয়েছে আসিফের ইশারায় গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক আহ্বায়ক ও গণ-অভ্যুত্থানে ৯ দফার ঘোষক আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশেরও। আসিফের অনুসারী আব্দুল কাদের বর্তমানে এনসিপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন ও জাতীয় ছাত্রশক্তির কোনো পদে নেই। সব মিলিয়ে দূরত্ব বাড়ছে অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ আসিফ ও এনসিপি’র মধ্যে। এনসিপিকে এতদিন বিভিন্নভাবে দিয়ে আসা সহায়তা আসিফ আগের মতো করছেন না বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে। এনসিপি নেতাদের কেউ কেউ এ-ও বলছেন আসিফ অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর সঙ্গে ‘বিট্রে (বিশ্বাসঘাতকতা)’ করছেন। 

আসিফ গতকাল ঢাকার-১০ আসনের ধানমণ্ডি এলাকায় ভোটার হওয়ার আবেদন করেছেন। গুঞ্জন রয়েছে তিনি এ আসনে নির্বাচন করতে চান। এই আসনে বিএনপি’র পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রার্থী মনোনয়ন দেয়নি। এতদিন আলোচনা ছিল কুমিল্লা-৩ আসনে নির্বাচন করতে চান আসিফ। এই আসনে বিএনপি’র প্রার্থী করা হয়েছে জনপ্রিয় নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদকে। গুঞ্জন রয়েছে আসিফ বিএনপি’র হয়েও নির্বাচন করতে পারেন। কুমিল্লা-৩ আসনে বিএনপি’র সিনিয়র নেতা ও জনপ্রিয় প্রার্থী থাকায় আসিফ ঢাকা-১০ এ নির্বাচন করতে চাইছেন। 

৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। এরপর সরকার থেকে পদত্যাগ করে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে গত ফেব্রুয়ারিতে গঠিত হয় জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি। দল গঠন থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রক্রিয়ায় পেছন থেকে কাজ করেছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও। 

শুরুতে উপদেষ্টারা নির্বাচন করবেন না বলা হলেও এখন তারা নির্বাচনমুখী। সরকার থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। শিগগিরই তিনি সরকার থেকে পদত্যাগ করে ঢাকা-১০ আসনে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করবেন বলে তার অনুসারীরা জানিয়েছেন।

এর আগে গত ২৪শে অক্টোবর এনসিপি থেকে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় দলটির শীর্ষ কোনো কোনো নেতা নাসিরকে বুঝিয়ে পদটি আসিফ মাহমুদের চাওয়া অনুযায়ী তাকে দিতে চেয়েছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নাসির পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলে তারা সে অবস্থান থেকে সরে আসেন। ওইদিন রাত ২টায় এনসিপি’র যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাতের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী আমাদের সঙ্গেই আছেন। তিনি কিছুদিন আগেও নির্বাচন কমিশনে পার্টি নিবন্ধন-সংক্রান্ত কাজে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়াও মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে তিনি বিভিন্ন উইংয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। তার পদত্যাগের বিষয়টি কিংবা দল থেকে অব্যাহতি নেয়ার বিষয়টি সঠিক নয়।’ সব মিলিয়ে শীতল এক দ্বন্দ্বে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও এনসিপি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তিতে অনুসারীরা শীর্ষ পদে আছেন। যে কারণে অস্বস্তিতে আছে এনসিপি। 

ওদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে গত শুক্রবার বাংলামোটরের রূপায়ন ট্রেড সেন্টারে এনসিপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। গভীর রাত পর্যন্ত চলা ওই বৈঠকে দলটি আগামী নির্বাচন এককভাবে করবে, না জোটগতভাবে সে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব পায়। সেক্ষেত্রে জোটগত নির্বাচন ও এককভাবে করার পরবর্তী ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা হয়। সাধারণ সভার সদস্যরা জোটগত নির্বাচনে না গিয়ে এনসিপিকে একক নির্বাচনের পরামর্শ দেন। যেটি দলটির আপাতত সিদ্ধান্ত-একক নির্বাচনের। সভায় নেতারা বলেন, জোট করলে দল এবারই সংসদে কিছু আসন পাবে ঠিকই কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সেটি রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হবে। এ ছাড়া বিএনপি’র সঙ্গে জোট করলে তাদের ছেড়ে দেয়া আসনে তৃণমূলের নেতারা এনসিপি’র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন কিনা, বিএনপি’র বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কিনা- সেটি নিয়েও সংশয় রয়েছে। দলটির বিরুদ্ধে এতদিন সংস্কারবিরোধী, চাঁদাবাজি, দখলদারিসহ যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে এনসিপি’র তরফ থেকে সেগুলোরও দায় এনসিপি’র প্রতি পড়বে বলে মনে করেন অনেকে। সভায় জামায়াতের সঙ্গেও জোটে যাওয়ার সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে আলোচনা হয়। দলটির সঙ্গে গেলে বিএনপি থেকে বেশি আসনে লড়া যাবে মানলেও তাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান ও ইসলামী রাজনীতির কারণে সায় নেই অনেকের। এনসিপি চাইছে একটি মধ্যপন্থা দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে। তবে জামায়াতের সঙ্গে গেলে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা একযোগে এনসিপি’র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন বলে মনে করেন অনেকে। এ ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত কোনো জোটে না গিয়ে এককভাবে নির্বাচন করলে ডাকসু’র মতো ভরাডুবি হতে পারে- এমন আশঙ্কাও রয়েছে দলটিতে। ডাকসু’র পর দলটির ছাত্রসংগঠন বাগছাস যেভাবে ছাত্ররাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে এনসিপিও সংসদে না যেতে পারলে অমন অবস্থা হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তাই জোট ও একক নির্বাচন নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি দলটি। সাধারণ সভা থেকে দাবি করা হয়-জোট করলে অবশ্যই সাধারণ সভার অনুমোদন নিতে হবে। শীর্ষ নেতারা এককভাবে জোট করলে সাধারণ সভা সেটি গ্রহণ করবে না। এতে দল ভাঙনের মুখেও পড়তে পারে।

এনসিপি’র এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ মুহূর্তে জোটে যাওয়া না যাওয়ার দু’টা দিক আছে। গেলে সাময়িক লাভবান হবে এনসিপি। আর না গেলে দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হবে। আবার জোটে না গিয়ে এককভাবে নির্বাচন করলে যদি ডাকসুর মতো ভরাডুবি হয় তাহলে এনসিপি’র ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়েও শঙ্কা তৈরি হবে। তাই ভেবেচিন্তে আগাতে হচ্ছে। আর উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে দূরত্বের বিষয়ে তিনি বলেন, তার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সত্য। তাকেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি কি অভ্যুত্থানের শক্তির সঙ্গে থাকবেন, না ক্ষমতার সঙ্গে।