Image description
৩৮ বছর পর সংশোধন হচ্ছে রাজউক আইন

এবার ৩৮ বছর পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আইনটি অধ্যাদেশ আকারে সংশোধন হতে যাচ্ছে। সব ধাপ পার হয়ে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। জনস্বার্থের বিষয়টি প্রাধান্য দিতে শেষমুহূর্তে এসে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সর্বশেষ ভেটিংসহ প্রয়োজনীয় মতামত চাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধ্যাদেশটি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অনুমোদন পেলে নগর উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। এছাড়া রাজউকের ভেতর ও বাইরে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে বেশকিছু শাস্তির বিধানে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, রাজউককে আমলাতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বের করে আনতে সাবেক ডিআইটি সময়কার ট্রাস্টকে ফিরিয়ে আনা হবে। ‘ট্রাস্ট’ একটি আইনি কাঠামো। ট্রাস্ট হলে স্বায়ত্তশাসন বেশি থাকবে। জনসেবার মান ও জবাবদিহি বাড়বে।

রাজউকের বিদ্যমান আইনের নাম ‘টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৩’। যুগোপযোগী করে যা এখন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অধ্যাদেশ-২০২৫ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। এ আইনে বিদ্যমান রাজউক পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসংখ্যা ৫ জনের স্থলে ১০ জনে উন্নীত করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৫ জন সার্বক্ষণিক এবং ৫ জন খণ্ডকালীন সদস্য হিসাবে থাকবেন। বড় পরিবর্তনগুলোর মধ্যে কেউ রাজউকের মাস্টার প্ল্যান অমান্য করলে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে, যা আগে ছিল না। তবে একই অপরাধ অব্যাহত থাকলে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা গুনতে হবে।

রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘রাজউক অধ্যাদেশ-২৫-এর কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। শেষ পর্যায়ে এসে বোর্ড সদস্য কারা হবেন এবং আরও কিছু বিষয়ে পেশাজীবীদের কাছ থেকে কিছু প্রস্তাবনা এসেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে।’

সূত্র জানায়, আইনটি সংশোধন করতে রাজউক ৯ বছর ধরে কাজ করছে। নানা ধরনের সংযোজন-বিয়োজন শেষে যা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর পানি ভবনে সংশোধিত অধ্যাদেশ নিয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পেশাজীবীরা রাজউককে আমলানির্ভরতা থেকে বের করে আগের ট্রাস্টের আদলে রাজউককে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সেবা প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার জোর সুপারিশ করেন। এরপর আইনটি সংশোধন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রস্তাবনা চায় রাজউক। মতামত পাওয়ার পর শিগ্গির সভা করে অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজউকের বিদ্যমান এ আইনটি যুগোপযোগী করার জন্য অনেক আগে থেকে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি জানানো হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে রাজউক আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। সব বিভাগের মতামত নিয়ে ২০১৯ সালে রাজউক আইনের খসড়া প্রস্তুত করার কাজ শেষ করে। এরপর দফায় দফায় ইনহাউজ সভা করে আরও যুগোপযোগী ও নির্ভুল করা হয়। একপর্যায়ে ২০২০ সালে আইনের খসড়া গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, রাজউক আইনের খসড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর কখনো কচ্ছপগতিতে, কখনো আবার এর কাজ মাঝপথে এসে স্থবির হয়ে পড়ে। এর মধ্যে তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে সরকারের পতন এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। এসব কারণে আইন সংশোধন উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয়। যে কারণে আইনটি চূড়ান্ত হতে রাজউককে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, রাজউক আগে ডিআইটি ছিল। অর্থাৎ ট্রাস্ট আইনে পরিচালিত হতো। তখনকার ওই নগর সংস্থা থেকে এই শহরের ইতিবাচক উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু রাজউক হিসাবে আত্মপ্রকাশ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি কাঙ্ক্ষিত নগর উন্নয়নসহ রাজধানীবাসীর প্রত্যাশা সেভাবে পূরণ করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ-রাজউককে আমলানির্ভর সংস্থায় পরিণত করা। তাই সত্যিকারার্থে রাজউককে গতিশীল দেখতে চাইলে এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

তিনি জানান, সম্প্রতি রাজউক অধ্যাদেশ-২৫-এর বাস্তবায়ন সংক্রান্ত এক সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বিষয়গুলো তিনিসহ অন্য পেশাজীবীরাও তুলে ধরেন এবং ট্রাস্টে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মতামত দেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্থপতি ইনস্টিটিউট থেকে এ বিষয়ে লিখিত প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানান, স্থপতিদের পক্ষ থেকে ৯ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে চেয়ারম্যানসহ ৩ জন রাজউক থেকে, ৩ জন পেশাজীবী এবং বাকি ৩ জন থাকবেন জনপ্রতিনিধি। রাজউক আওতাধীন এলাকার সিটি ও পৌর মেয়ররা জনপ্রতিনিধির আওতায় পড়বেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, আমলানির্ভর পরিচালনা পর্ষদ দিয়ে রাজউক ভালোভাবে চলছে না, ভবিষ্যতেও চলবে না। এজন্য আইন সংশোধন করে পুনরায় আমলানির্ভর করার কোনো মানে হয় না। এ বিষয়গুলো রাজউকের আইন সংশোধন সংক্রান্ত সভায় তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে এ বিষয়ে সবাই নীতিগত সম্মতি দিয়েছে।

তিনি জানান, রাজউকের ওই সভায় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে আইন প্রণয়ন করার প্রস্তাব করা হয়। কেননা এ দুটি বিষয় রাজউকের প্রধান কাজ। কিন্তু রাজউক তা না করে উন্নয়ন কাজে তাদের বেশি মনোযোগ। অর্থাৎ প্রকল্প প্রণয়ন, প্লট ও ফ্ল্যাট তৈরিতে রয়েছে বিশেষ আগ্রহ। তবে এখান থেকে রাজউককে বেরিয়ে আসতে হবে।

শাস্তির বিধানে যা আছে : ১. রাজউক এলাকার কোনো ব্যক্তি পূর্বানুমোদন ছাড়া নিরাপত্তাবেষ্টনী, খুঁটি বা পোস্ট সরিয়ে ফেললে তাকে ২ বছর জেল, অথবা ৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। ২. কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে সড়ক বা কোনো ইমারতের পাশে বিধিমোতাবেক সংরক্ষিত খোলা জায়গায় ১০ ফুটের বেশি দেওয়াল বা ভবন নির্মাণ করলে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধানা রাখা হয়েছে। কুঁড়েঘর নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা দেওয়া হবে ৩ মাসের জেল। ক্ষেত্রবিশেষ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে অপরাধ অব্যাহত থাকলে পাকা দেওয়াল বা ভবনের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার টাকা এবং কুঁড়েঘরের ক্ষেত্রে প্রতিদিন ২ হাজার টাকা করে জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। ৩. সড়ক দখল করে স্থাপনা, ভবনের সীমানারেখায় দেওয়াল বা স্থাপনা তৈরির পর রাজউক সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিলে তা পালন না করা হবে অপরাধ। এক্ষেত্রে পাকা দেওয়াল বা স্থাপনা অপসারণ না করলে ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাসের জেল বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। কুঁড়েঘর নির্মাণের জন্য ৭ লাখ টাকা জরিমানা অথবা ৪ মাসের জেল বা উভয়দণ্ড পাবেন। এছাড়া অপরাধ অব্যাহত থাকলে পাকা দেওয়াল বা ভবনের ক্ষেত্রে প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং কুঁড়েঘরের জন্য প্রতিদিন ৩ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হবে। ৪. রাজউকের কাজে কেউ বাধা দিলে তাকে সর্বোচ্চ ৪ মাসের কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। ৫. কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া নিচু ভূমি ভরাট কিংবা পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করলে ২ বছরের জেল বা ১০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে। ৬. আদালত কোনো ব্যক্তিকে কোনো দেওয়াল, ইমারাত বা স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দেওয়ার পরও তা অপসারণ না করলে ২ বছরের জেল বা ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। ৭. কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নিয়ে জনস্বার্থে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারবে। তবে বিষয়টি নিয়ে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে আরও নতুন কিছু বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-ক. উন্নয়নস্বত্ব বিনিময় : রাজউক এলাকায় সরকারি কোনো উন্নয়নকাজের ফলে যদি ওই এলাকায় ভূমির মূল্য বেড়ে যায়, সেক্ষেত্রে সরকার ওইসব ব্যক্তির বা জায়গার মালিকদের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করবে। এটা হতে পারে অর্থ বা ভূমি উন্নয়নের অংশবিশেষ। অবশ্য এ বিষয়ে বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে। সেখানে বিস্তারিত নির্দেশনা থাকবে এবং সবকিছু ভালোভাবে স্পষ্টীকরণ করা হবে।

খ. নগর পুনঃউন্নয়ন : এই উদ্যোগের মাধ্যমে শহরের কোনো ঝুঁকিপূর্ণ, জরাজীর্ণ ও অপ্রতুল এলাকাকে বসবাস উপযোগী করা হবে। বিশেষ করে সহজাত বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে ওই এলাকার জীবনমান, অর্থনৈতিক অব্যবস্থা ও কাঠামো উন্নয়ন করে বসবাস উপযোগী হিসাবে তৈরি করা যাবে।

গ. ভূমির পুনর্বিন্যাস : রাজউক এলাকার একাধিক মালিকানাধীন খণ্ডিত জমিগুলো একীভূত করে একক ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। পরিকল্পনার আওতায় প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সব ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো অর্থাৎ রাস্তা, ড্রেন, পার্ক ও গণপরিসর অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।

এছাড়া বিদ্যমান বাস্তবতায় এ অধ্যাদেশে জনস্বার্থে সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন, সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে। এটি অনুমোদন পেলে এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন হলে রাজধানীর চেহারা পরিবর্তনে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত, ১৯৫৩ সালে তৎকালীন সরকার এই অঞ্চলের জন্য টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৩ প্রণয়ন করে। এ আইনের আওতায় সরকার ১৯৫৬ সালে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার উন্নয়ন ও পরিবর্তনের ক্ষমতা দিয়ে প্রথম ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) গঠন করা হয়। এরপর ১৯৮৭ সালে এই আইন পরিবর্তন করে সরকার রাজউক গঠন করে।