Image description
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে দিনে মারা যান ২০ রোগী

সারা দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ভোগান্তির শেষ নেই। জেলাগুলোর বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালে আক্রান্তের জন্য কোনো প্রয়োজনীয় সেবা নেই। ঢাকার বাইরের রোগীরা সঠিক সময়ে ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা না পাওয়ায় বিপদে পড়ছেন। ফলে রোগীদের সব চাপ ঢাকায়। আবার ঢাকায় সরকারিভাবে একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৮০ ভাগ রোগীর চাপ। এই চাপ সামলাতে গিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত চার বছরে এই হাসপাতালে ভর্তি রোগী বেড়েছে ৮২ শতাংশ। সেই সঙ্গে বেড়েছে মৃত্যুও। সর্বশেষ চলতি বছরের ৮ মাসে মারা গেছেন ৪ হাজার ৮৪১ জন।

এতে দেখা যায়, প্রতিমাসে মারা যান ৬০৫ জন এবং দিনে গড়ে মারা যান ২০ জন। ১২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে গড়ে রোগী ভর্তি থাকছেন ১৬০০ জন। এতে প্রতিনিয়ত বাড়তি রোগীর জরুরি চিকিৎসা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সরকারিভাবে অন্য হাসপাতালগুলোয় হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী ভর্তি বা মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই। এমন এক বাস্তবতায় সারা বিশ্বের মতো আজ (২৯ সেপ্টম্বর) দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব হৃদরোগ দিবস-২০২৫। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘ডোন্ট মিস এ বিট অর্থাৎ প্রতিটি হৃৎস্পন্দনই জীবন’। এর দ্বারা বার্তা দেওয়া হয়েছে-‘সতর্কতামূলক লক্ষণ উপেক্ষা না করি, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও হার্টের যত্ন নিই।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রোগ এখন অনেকটা মহামারির মতো। এর থেকে মুক্তি পেতে ওষুধ বা হাসপাতাল দিয়েই হবে না। বড় উপায় সচেতনতা। প্রত্যেককে হৃদরোগের বিষয়ে জানতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে হবে।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের দক্ষিণ ব্লকের দ্বিতীয়তলায় অবস্থিত ‘পোস্ট করোনারি কেয়ার ইউনিট তথা (পিসিসিইউ) ওয়ার্ডে ভর্তি ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে আসা রোগী ফরিদা ইয়াসমিন (৫৫)। গত ২৭ আগস্ট তার হার্ট অ্যাটাক হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ৫ দিন ভর্তি থাকার পর বলা হয়, এনজিওগ্রামের সিরিয়াল পেতে এক মাস অপেক্ষা করতে হবে। বাধ্য হয়ে তিনি ঢাকার এই হাসপাতালে চলে আসেন। জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ১ লাখ ২৪ হাজার ৪৩৪ জন এবং বহির্বিভাগে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৬ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সময় ভর্তি হন ৭৫ হাজার ৫১২ জন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ৪ হাজার ৮৪১ জন রোগী। সারা দেশে প্রতিবছর প্রায় পৌনে তিন লাখ (২ লাখ ৮৩ হাজার) মানুষ হৃদরোগে মারা যান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে ঢাকাকেন্দ্রিক। যার সামর্থ্য আছে, তিনি চিকিৎসা নিতে পারছেন। যার সামর্থ্য নেই, তিনি পাচ্ছেন না। দেশে যে চিকিৎসা আছে, সেখানে এনজিওগ্রাম, রক্তনালিতে স্টেন্ট (রিং পরানো), বাইপাস সার্জারি, ক্যাথল্যাব সবই ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীকেন্দ্রিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেগুলোর সুযোগ-সুবিধা নেই। রোগীর অস্বাভাবিক চাপ বাড়ছে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয়। যেখানে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে উচ্চবিত্তদের বড় একটি অংশ বিদেশে যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, কারও হার্টের রক্তনালিতে ব্লক আছে কি না বোঝার জন্য প্রথমে উপসর্গ অনুযায়ী ইকো-কার্ডিওগ্রাম এবং তারপর ইটিটি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রক্তনালিতে ব্লক সন্দেহ হলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এনজিওগ্রাম করা হয়। দুঃখজন ব্যাপার হলো-এই মুহূর্তে ঢাকায় সরকারি ৫টি, স্বায়ত্তশাসিত একটি ও বেসরকারি ২৯টিসহ ৩৫টি হাসপাতালে এনজিওগ্রাম পরীক্ষা করা হয়। ঢাকার বাইরে ৫টি সরকারি এবং ১৯টি বেসরকারি হাসপাতালে এনজিওগ্রামের ব্যবস্থা আছে।

সিওমেক হাসপাতালে সক্ষমতার পাঁচগুণ রোগী : সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন ভিড় জমে হৃদরোগীদের। অথচ সে তুলনায় চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। হৃদরোগ বিভাগের পরিচালক ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. মুখলেসুর রহমান বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে আসা রোগীরা অধিকাংশই হতদরিদ্র। ক্লিনিকে তাদের চিকিৎসার সামর্থ্য নেই। অথচ এ হাসপাতালে আছে মাত্র ৩৪ বেডের হৃদরোগ বিভাগ। এ সামান্য সামর্থ্য দিয়েই নিয়মিত দেড়শ রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি জানান, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে টেকনিশিয়ান নিয়ে। সরেজমিনে শনিবার চিকিৎসকসহ সব স্টাফ থাকলেও একমাত্র টেকনিশিয়ান ছুটিতে থাকায় ক্যাথল্যাবের কোনো কাজই হয়নি। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক ডা. মাহবুবুল আলম জানান, শুধু বহির্বিভাগেই গত এক বছরে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ছয় হাজার ৮৭৩ জন রোগীকে। হৃদরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আদিল জানান, প্রায় এক বছরে আউটডোর-ইনডোরে ১৫ হাজার ১২৬ জন হৃদরোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসাসেবা নিতে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ৫.৫ শতাংশ। কার্ডিওলজি বিভাগ জানায়, গত এক বছরে এনজিওগ্রাম সেবা গ্রহণ করেছেন মোট ৮৩১ জন। রিং পিসিআই লাগিয়েছেন ৮০ জন, টিপিএম করেছেন ১৪৩ জন, পিপিএম করেছেন ১০ জন, পেরিকার্ডিও সেন্টেসিস করেছেন ৭৩ জন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ওসমানীতে বর্তমানে দুটি ক্যাথল্যাব রয়েছে। একটি পুরোনো। ২১ সেপ্টেম্বর নতুন ক্যাথল্যাবটি উদ্বোধন হয়। ৪৬০ শয্যাবিশিষ্ট ভবনে ক্যানসার, কিডনি ও হৃদরোগীরা চিকিৎসা নিতে পারবেন। ১০০ শয্যা বরাদ্দ রাখা হবে শুধু হৃদরোগীদের জন্য। পুরো ওসমানীতে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার রোগী সেবা নিয়ে থাকেন আউটডোরে। ৯০০ শয্যার হাসপাতাল হলেও প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকেন দুই হাজার ৮০০ জন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ইনডোর ও আউটডোরে প্রায় ৩৩ হাজার রোগী রোগ নির্ণয়সেবা গ্রহণ করেছেন।