Image description
চামড়া খাতে সংকট

বাংলাদেশের চামড়াশিল্প এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বার্ষিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি সীমা অতিক্রম করতে পারছে না। অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়াশিল্প থেকে বার্ষিক ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির পরিকল্পনা করছে সরকার। ২০৩৫ সালের মধ্যে রপ্তানির পরিমাণ ১০ বিলিয়নে উন্নীত হতে পারেও বলে আশা ব্যক্ত করছেন তারা। তবে আন্তর্জাতিক মানের অভাব, অপরিকল্পিত অবকাঠামো, বিনিয়োগের ঘাটতি এবং পুরোনো প্রযুক্তি শিল্পটিকে আটকে রেখেছে। বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের চামড়াকে প্রিমিয়াম মূল্যে কিনতে চাইছে না, আর স্থানীয় ট্যানারিরা সীমিত মুনাফার মধ্যেই আটকে পড়েছে। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া খাতে রপ্তানির যে লক্ষ্য, সেটা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান খাতসংশ্লিষ্টরা।

সাভার ট্যানারি শিল্প এস্টেট খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হলেও এখনো অসম্পূর্ণ। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) ঠিকমতো কাজ করছে না। বাংলাদেশে নিবন্ধিত ২২০টি ট্যানারির মধ্যে অধিকাংশই লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জন করতে ব্যর্থ। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না।

দেশে মাত্র ৮টি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজি সার্টিফাইড, যার মধ্যে এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড, অস্টান লিমিটেড, সুপারেক্স লেদার লিমিটেড, এবিসি লেদার লিমিটেড, রিফ লেদার লিমিটেড, এসএএফ লেদার লিমিটেড, সংশিন লেদার এবং সিমোনা ট্যানিং লিমিটেড রয়েছে। এলডব্লিউজি সনদ পেতে ১৭টি বিভাগে মোট ১ হাজার ৭১০ নম্বর পেতে হয়। যার মধ্যে ৩০০ নম্বর পেতে হয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। মোট নম্বরের ৫০ শতাংশ পেলেই একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘নিরীক্ষিত’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এলডব্লিউজির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আড়াই হাজারের বেশি চামড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত এই সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে ইতালির ৯৬০টি, ভারতের ৩০১টি, চীনের ২৭৩টি, পাকিস্তানের ৬২টি, ভিয়েতনামের ২৭টি, তাইওয়ানের ২৪টি ও থাইল্যান্ডের ২২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৩৯৭ দশমিক ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নেমে এসেছে মাত্র ১২৭ মিলিয়নে। অর্থাৎ গত এক দশকে রপ্তানি কমেছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। অথচ বিশ্ববাজারে চামড়াজাত পণ্যের মোট মূল্য প্রায় ৪২০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রায় সামান্য।

বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন বর্গফুট চামড়া উৎপাদন করে, যা বিশ্বে শীর্ষ চামড়া উৎপাদনকারীদের মধ্যে একটি। তবু স্থানীয় চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারকরা প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের সমান এলডব্লিউজি সার্টিফাইড চামড়া আমদানি করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বাড়ছে। অধিকাংশ ট্যানারি পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে। আধুনিক, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে উন্নীত করতে যে পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন, তা অনেক কারখানার পক্ষে বহনযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য কম থাকায় মুনাফার মার্জিনও সীমিত।

ট্যানারিরা নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনের চেষ্টা করলেও সরকারের অনুমোদন সীমিত। এখন পর্যন্ত কেবল পাঁচটি ট্যানারি পৃথক ইটিপি স্থাপন করার অনুমোদন পেলেও আর্থিক ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে শীর্ষ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। এলডব্লিউজি সনদ প্রাপ্তিতে পিছিয়ে থাকায় বাংলাদেশ ইউরোপের বাজার ধরতে পারছে না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা সিইটিপি দ্রুত সমাপ্তি ও আধুনিকীকরণ, এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশনকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা, কর ছাড় বা সহজ ঋণের মাধ্যমে সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. আবু ইউসুফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি সরিয়ে নিলেও সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে মান উন্নয়ন হয়নি। সেখানে সিইটিপির সক্ষমতা ২৫ হাজার কিউবিক ঘনমিটার বলা হলেও আছে ১৫ হাজার কিউবিক ঘনমিটার। সরকার থেকে চার থেকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ইটিপি স্থাপন করার অনুমোদন দিলেও সেগুলো এখনো হয়নি। ২০৩০ সালে সরকার থেকে চামড়া রপ্তানির যে ৫ বিলিয়ন ডলারের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে সেটা সম্ভব হবে যদি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়।

বাংলাদেশ চামড়াজাত পণ্য এবং পাদুকা প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, সনদ না থাকায় আমরা বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি। ন্যায্যমূল্যে দাম না পাওয়ায় অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এ খাত থেকে। এতে ধস নেমেছে এ খাতে। এলডব্লিউজি সনদ থাকলে বেশি দামে চামড়া বিক্রি করা যেত। বিদেশি বাজারেও শক্ত অবস্থান করা যেত। এতে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো সংকট থাকত না।