
চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদীবাগে ১৯৯৭ সালের ৬ জুলাই গুলি করে হত্যা করা হয় সরকারি সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক সিনাউল হক আশিককে। এ ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। আদালত পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মিজানুর রহমানের আদালত পাঁচ আসামিকেই খালাস দেন।
২০১১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুরের একটি গির্জায় হত্যার শিকার হন শিক্ষক সুব্রত বৈদ্য। এ ঘটনায় দারুস সালাম থানায় হওয়া মামলার তদন্ত শেষে ২০১৩ সালে ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। বিচার প্রক্রিয়া শেষে ১৩ মার্চ ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৮-এর বিচারক মো. মঞ্জুরুল হোসেনের আদালত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সব আসামিকে খালাস দেন।
শুধু আশিক ও সুব্রত বৈদ্য হত্যার ঘটনায় নয়, দেশে প্রতিবছর সাড়ে চার হাজারে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হওয়া মামলার বেশির ভাগই প্রমাণ করা যাচ্ছে না। বছরের পর বছর তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে অনেক মামলার আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। হত্যা মামলায় সাজার হার কম হওয়ার কারণ অনুসন্ধান সংক্রান্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। সংস্থাটি বলছে, দেশের হত্যা মামলার ৫১.৬৮ (প্রায় ৫২) শতাংশই প্রমাণ করা যাচ্ছে না। এসব মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। খালাসপ্রাপ্ত মামলার মধ্যে ৩৮.২ শতাংশ বাদী ও বিবাদী আপস এবং ১১.৪ শতাংশ তদন্তে ত্রুটির কারণে হচ্ছে। এছাড়া সাজাপ্রাপ্ত মামলার ২৬.১ শতাংশ মৃত্যদণ্ড, ৪১.৭ শতাংশ যাবজ্জীবন এবং ৩২.২ শতাংশ সাধারণ সাজা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬২ শতাংশই পূর্বশত্রুতা থেকে হয়েছে। এছাড়া ৪০ শতাংশ বৈবাহিক, ২৪ শতাংশ হত্যাকাণ্ড জমি বা সম্পত্তিসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব থেকে এবং ১৯ শতাংশ পূর্বপরিকল্পিতভাবে হয়েছে।
হত্যা মামলার তদন্তে পুলিশের সর্বোচ্চ ১৯ বছর সময় লেগেছে। আর পুলিশ চার্জশিট দাখিলের পর আদালতে বিচারকার্যে সর্বোচ্চ ৩০ বছর সময় লেগে গেছে।
দেশের নয়টি এলাকার (জেলা ও মেট্রোপলিটন) ৯০টি থানার ২০১৫ ও ২০১৬ সালের ২৩৮টি হত্যা মামলায় রায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে উল্লিখিত সব তথ্য পেয়েছে পিবিআই।
পিবিআই বলছে, অধিকাংশ মামলার খালাসের নেপথ্যে বাদী-বিবাদীর আপসের কারণে বৈরী সাক্ষী। অর্থাৎ সাক্ষী কর্তৃক সঠিকভাবে সাক্ষ্য প্রদান না করা অথবা সাক্ষীর অনুপস্থিতি। এছাড়া আদালতের পর্যবেক্ষণে মামলার তদন্তেও বেশকিছু ত্রুটিবিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের উপস্থাপিত তদন্ত প্রতিবেদনেও বেশকিছু অসামঞ্জস্য পাওয়া যায়, যার প্রভাব পড়ে বিচারিক আদালত কর্তৃক মামলার রায়ে। জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় অধিকাংশ মামলায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ ও শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যর্থতার দায়ভার অনেকাংশে পুলিশকেই বহন করতে হয়। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে তদন্ত তথা সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ ও উপস্থাপন এবং তদন্ত প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই পিবিআই বস্তুনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত করতে এবং তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে বিদ্যমান তদন্ত প্রক্রিয়ার ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাগুলো জানার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
তিনি বলেন, সারা দেশে বৃহৎ পরিসরে অনুসন্ধান করলে আরও সুন্দর হতো। কিন্তু মামলার রায়গুলো কালেকশন করা একটি মহাযুদ্ধ। এটা চাইলেই আদালতগুলো থেকে ঠিকমতো পাওয়া যায় না।
তবে সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে বছরে গড়ে সাড়ে তিন হাজার হত্যা মামলা হয়। আমার ধারণা, এর মধ্যে গড়ে ৩০ শতাংশ মামলার শাস্তি নিশ্চিত হয় না। সারা বিশ্বে মার্ডার ডিটেক্ট করা সহজ উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে মার্ডারের ক্লিয়ারেন্স রেট ৯০ শতাংশের বেশি। আমাদের দেশে মার্ডার মামলায় শাস্তি না হওয়ার মূল কারণ পুলিশের অদক্ষতা।
সূত্র বলছে, পিবিআই ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, চট্টগ্রাম জেলা, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন, রংপুর, বগুরা, ফরিদপুর ও বরিশাল এলাকার হত্যা মামলার রায় নিয়ে অনুসন্ধান করে। হত্যা মামলাগুলোর সাজার হার তুলনামূলক কম হওয়ার কারণ জানতে দেশের বিভিন্ন জেলায় পিবিআই-এর ইউনিটপ্রধানরা তাদের নিজ নিজ দায়িত্বাধীন জেলায় বিচারকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের মতামত গ্রহণ ও অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করেন। এছাড়া মামলার রায়ে আসামিদের খালাসের ব্যাপারে আদালতের পর্যবেক্ষণগুলো সংগ্রহ করে। পিবিআই এসব মামলার রায়ের কপি ও পর্যবেক্ষণগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
পিবিআই অনুসন্ধান প্রতিবেদনের খালাসপ্রাপ্ত ১২৩টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু বৈরী সাক্ষীর (বাদী ও বিবাদীর আপসজনিত) কারণে খালাসপ্রাপ্ত মামলা সংখ্যা ৪৭টি অর্থাৎ ৩৮.২ শতাংশ। শুধু তদন্তে ত্রুটিজনিত কারণে খালাস হয়েছে ১৪টি মামলা অর্থাৎ ১১.৪ শতাংশ। ম্যাজিস্ট্রেটের ভুলের কারণে ৪টি, অর্থাৎ ৩.২ শতাংশ। পিএম রিপোর্টের ত্রুটিজনিত কারণে ১১টি, অর্থাৎ ৮.৯ শতাংশ। তদন্তে ত্রুটি ও বৈরী সাক্ষীর যুগপৎ কারণে খালাসপ্রাপ্ত মামলার সংখ্যা ৩২টি, অর্থাৎ ২৬ শতাংশ। ১৫টি মামলায় পরিপূর্ণ অর্থাৎ বাদী সাক্ষী এবং প্রসিকিউশন সক্রিয় ছিল তথাপি মামলা খালাস হয়, যা শতকরা হিসাবে ১২.২ শতাংশ।
কেন খালাস পাচ্ছে আসামিরা : পিবিআই-এর অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বিচারক, পিপি ও তদন্তকারী কর্মকর্তার পর্যবেক্ষণে হত্যা মামলার আসামি খালাসের কারণ ওঠে এসেছে। হত্যা মামলার এই প্রধান তিনটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পিবিআই জানতে পেরেছে কেন খালাস পাচ্ছে আসামিরা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, এজাহারে ত্রুটি থাকা, তদন্ত কর্মকর্তার সততার অভাব বা স্বার্থান্বেষী মহলের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া, মামলার এজাহার/ লাশের সুরতহাল/ ব্যবহৃত অস্ত্র এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের মধ্যে মিল না থাকা। এছাড়াও সঠিকভাবে তদন্ত না হওয়া, মৌখিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রিপোর্ট দেওয়া, তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগা ও প্রযুক্তির ব্যবহার না করার ফলেও মামলা প্রমাণিত হয় না। ১৬১/১৬৪ ধারায় জবানবন্দি না থাকা, প্রত্যক্ষ সাক্ষী আদালতে হাজির করতে ব্যর্থতা ও প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকা, উপযুক্ত সাক্ষী নির্বাচন না করা, সাক্ষীর মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া এবং সাক্ষীদের কোনো প্রণোদনা না থাকাও অন্যতম কারণ। পিবিআই-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাক্ষীদের যথাযথভাবে প্রস্তুত না করে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য হাজির করা, সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান না করা বা হাজির না হওয়া, আসামিদের ভয়ে বা প্রভাবে সাক্ষী কর্তৃক সত্য সাক্ষ্য না দেওয়া, পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করতে না পারা, আলামত ও অন্য প্রমাণাদি জব্দ না করা/আদালতে উপস্থাপনে ব্যর্থতা এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার অদক্ষতার কারণেও মামলা প্রমাণ হয় না। বিচারে দীর্ঘ সময় লাগায় বাদীপক্ষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা বা বাদীপক্ষের অনীহা এবং প্রসিকিউশনের গাফিলতির কারণেও মামলা প্রমাণিত হয় না। বাদীপক্ষ আর্থিক অক্ষমতায় দক্ষ উকিল দিতে না পারা, প্রকৃত দোষী/দোষীদের ছাড়াও অন্যদের আসামি করা, আসামিদের জামিন-পরবর্তী অপতৎপরতা ও রাজনৈতিক বিবেচনাও অন্যতম কারণ।
তবে এর মধ্যে চার ধরনের ত্রুটিকে মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে পিবিআই। সেগুলো হলো: প্রথমত-বৈরী সাক্ষীর কারণে, দ্বিতীয়ত-তদন্তের ত্রুটিজনিত কারণে, তৃতীয়-ম্যাজিস্ট্রেটের ভুলের কারণে (জব্দতালিকা/১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দি সঠিকভাবে না নেওয়া), এর সঙ্গে বৈরী সাক্ষী তদন্তের ত্রুটি ও আদালতের জটিলতা যুগপৎভাবে রয়েছে। চতুর্থ-পিএম রিপোর্টের ত্রুটিজনিত কারণে এর সঙ্গে বৈরী সাক্ষী, তদন্তের ত্রুটি ও সাক্ষীর গরহাজির যুগপৎভাবে রয়েছে।
মামলা তদন্ত ও বিচার শেষ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে : বিবিআই-এর উল্লিখিত ২৩৮টি মামলার তদন্তে পুলিশের সময় লেগেছিল সর্বনিম্ন ১৮ দিন এবং সর্বোচ্চ ১৯ বছর, যা গড়ে ১ বছর ৬ মাস (প্রায়)। অন্যদিকে মামলাগুলো পুলিশ কর্তৃক চার্জশিট দাখিলের পর আদালত কর্তৃক বিচারকার্যে সময় লেগেছিল সর্বনিম্ন ৮ মাস এবং সর্বোচ্চ ৩০ বছর। গড়ে প্রায় ১০ বছর ১১ মাস।
দীর্ঘসময় বিচারকার্যের জন্য অনেক সময় বাদী ও সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে অথবা সাক্ষ্য দিতে চায় না। তাই সাক্ষী বৈরী হওয়ার সঙ্গে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার দেখা দেয়। মামলার তদন্ত ও প্রসিকিউশনের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও উঠে আসে পিবিআই-এর অনুসন্ধানে।
মামলায় শাস্তি নিশ্চিত হতে করণীয় : পিবিআই-এর অনুসন্ধান প্রতিবেদনে হত্যা মামলায় শাস্তি নিশ্চিতে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক চার্জশিটে শুধু প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিদের সাক্ষী করা। পিপি কর্তৃক সাক্ষীকে যথাযথভাবে প্রস্তুতপূর্বক আদালতে উপস্থাপন করা। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন/যুগোপযোগী করা ও বাস্তবায়ন এবং সাক্ষীদের জন্য উপযুক্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যাতে তারা সাক্ষ দিতে আগ্রহবোধ করে। এছাড়া হত্যা মামলার বাদীপক্ষকে স্থানীয় পুলিশ ও অন্যান্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের (যেমন- ইউনিয়ন পরিষদ) মাধ্যমে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রদান ও অন্যান্য সহযোগিতা করা। দ্রুততম সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করা এবং প্রসিকিউশন কর্তৃক বাদীপক্ষের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে যোগযোগ রেখে বাদীপক্ষ যাতে ভয় না পায়, হতাশ না হয় এবং আপস না করে, সে ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখা।