Image description

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানেই সবার দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে বিশাল ক্যাম্পাস, বড় বড় একাডেমিক ভবন, আবাসিক হল, বিশাল খেলার মাঠসহ অন্য আরো অনেক সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু তার বিপরীতটাই ঘটছে আমাদের দেশের নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে। ক্লাসরুমের জায়গা নেই, শিক্ষকদের বসার জায়গা নেই। লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি তো অনেক দূরের কথা।

নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু সংকট আর সংকট। এমনকি একটি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তাও নেই নতুন এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের কয়েকটি রুম ভাড়া নিয়ে কোনো রকমে চালানো হচ্ছে কার্যক্রম। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, দেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৬।

 
এর মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি। তবে ৫৬টির মধ্যে ২২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলছে ভাড়াবাড়িতে বা অস্থায়ী ক্যাম্পাসে। এর মধ্যে ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই করুণ। যেগুলোর একটি স্কুলের সুবিধাও নেই।
 
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বসার জায়গা করা হয়েছে একটি পরিত্যক্ত গাড়ির গ্যারেজে। তবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণে অগ্রগতি থাকলেও বেশির ভাগ জায়গা খুঁজতে খুঁজতেই হয়রান।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এত দিন স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তথ্য বারবার সামনে আসত। ইউজিসি থেকে তাদের তাগাদা দেওয়া হতো। যদিও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করতে হলে ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা দেখাতে হয়।

ফলে যত দিন তারা স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে না পারে তত দিন অন্তত বড় একটি জায়গায় তাদের ক্যাম্পাস থাকে।

অন্যদিকে কোনো স্কুল-কলেজের অনুমোদন পেতে হলেও এখন প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা জমিতে অবকাঠামো থাকতে হয়। কিন্তু গত পাঁচ-সাত বছর কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই মন্ত্রী-এমপিদের তদবিরে অনুমোদন পায় নতুন নতুন অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সেগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকায় আশপাশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকটি রুম ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

ভাড়া জায়গায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ; ইউনিভার্সিটি অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি, বাংলাদেশ; নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

ভাড়া জায়গায় থাকা আরো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ নিজস্ব ক্যাম্পাসের জন্য এখনো জমিই খুঁজে পায়নি। এর বাইরে আরো দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়াবাড়িতে চললেও তাদের ক্যাম্পাস নির্মাণ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে আর তাদের ভাড়া ক্যাম্পাসও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক ভালো। ভাড়াবাড়িতে থাকা রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো একটির ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ অনেকটা শেষের পথে।

এখনো শিক্ষা কার্যক্রম চালু না হওয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে মেহেরপুর বিশ্ববিদ্যালয়, নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনা ছাড়াই করা হয়েছে। তাদের অবকাঠামো নেই। আগের কমিশনও নিয়ম-কানুনের ব্যাপারে সচেষ্ট ছিল না। ফলে পুরো পরিস্থিতিটাই জটিল হয়ে পড়েছে। তারা উচ্চ শিক্ষার ন্যূনতম শর্ত পূরণ করতে পারছে না। ফলে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে।’

অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান আরো বলেন, ‘জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল। আসলে এখন এ ব্যাপারে যাচাই-বাছাই বা সমীক্ষা করা দরকার। যাদের ন্যূনতম সম্ভাবনা আছে তাদের রেখে বাকিগুলোকে পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করা যায় কি না সেটা ভাবতে হবে। আর নতুন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমরা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার অনুমতি দিতে পারছি না। আসলে তাদের কী হবে সে ব্যাপারেও মন্ত্রণালয় থেকেই সিদ্ধান্ত আসতে হবে।’

সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প (ডিপিপি) অনুমোদন ও তা বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিষ্ঠার ৯ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ শুরু না হওয়ায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। যদিও এরপর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়। কিন্তু যে জমিতে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের প্রকল্প পাস হয়েছে, সেখানে ক্যাম্পাস নির্মাণ করা অনেক কষ্টকর। ফলে কত বছরে তারা স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারবেন তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় শাহজাদপুর মহিলা কলেজের একটি ভবনের একাংশে অস্থায়ীভাবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে।

স্থায়ী ক্যাম্পাসের দাবিতে সম্প্রতি বিক্ষোভ করেছেন কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এমনকি তাঁরা তাঁদের দাবি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গ শাটডাউনেরও ঘোষণা দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ভূমি অধিগ্রহণের অনুমতিও পাওয়া গেছে। তবে প্রশাসন বলছে, পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে আরো সময় লাগবে। অন্যদিকে গুরুদয়াল কলেজ ভবনের কয়েকটি রুমে তাদের যে একাডেমিক কার্যক্রম চলছে, তারও কোনো চুক্তি নেই। কলেজ চাইলে যেকোনো সময় তাদের সরিয়ে দিতে পারে। অথচ বিকল্প কোনো অস্থায়ী ক্যাম্পাস নিয়েও প্রশাসন ভাবছে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগের সরকারের ভুল নীতির কারণে নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হয়েছে। কারণ প্রতিটি জেলায় একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সে লক্ষ্যে গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যত্রতত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। নতুন যেসব বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগ স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল টাকা কামানো।

দেখা গেছে, মন্ত্রী বা এমপির সুপারিশে বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। এগুলোর ভূমি অধিগ্রহণ, অবকাঠামো নির্মাণে লুটপাট করা হয়েছে বিপুল অর্থ। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে। ফলে নতুন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব একটা শিক্ষার্থী না থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীতে ভরপুর। এতে অনেক মন্ত্রী-এমপি তাঁর এলাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেলেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, অনেক জেলা আছে যেখানে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। এমনকি শহর ছেড়ে অনেক দূরে মন্ত্রী-এমপির বাড়ির কাছে মফস্বলেও কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। আবার অনেক জেলা আছে, যেখানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই। এতে অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অনেক দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইন পাস হওয়া কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি এমন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখতে চিঠি দিয়েছিলেন সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। গত বছর ১২ ডিসেম্বর ইউজিসি চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো চিঠিতে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী কম, সেখানে আপাতত নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করতেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

চিঠিতে সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় (সাধারণ ও বিশেষায়িত) স্থাপন করা হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভবিষ্যতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাঁড়াতে পারবে কি না তা পরিষ্কার নয়। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি, সেগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে যেকোনো পদক্ষেপ স্থগিত রাখাই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। এ ছাড়া যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন, সেগুলোতেও নতুন শিক্ষক বা কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি জরুরি প্রয়োজন না হলে এখন স্থগিত রাখাই ভালো। এসব বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগতভাবে পরবর্তী সরকারের ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার রেখে যাওয়াটা সমীচীন মনে করে।’

এর ফলে আটটি নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম আটকে গেছে। এর মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আর বাকি পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু আইন পাসের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ আছে।