
হৃদরোগের চিকিৎসায় বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে এ সক্ষমতার সবটুকু মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। পুরো দেশে হৃদরোগের অস্ত্রোপচারে বড় কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর বেশির ভাগের শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচারের জন্য ঢাকাই শেষ ভরসা।
সরকারি তথ্য মতে, দেশের ৯৫ শতাংশ হৃদরোগীর অস্ত্রোপচার হয় ঢাকায়। এর বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগীয় শহরে সীমিত আকারে অস্ত্রোপচার হয়।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ সোমবার পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’। এবার দিবসটির প্রতিপ্রাদ্য ‘প্রতিটি হৃদস্পন্দনই জীবন’।
দিবসটি উপলক্ষে আজ দেশজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
দেশে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়লেও এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে কম। ঠিক কত মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছে, কতজন মারা যাচ্ছে, ঝুঁকিতে আছে কত মানুষ—এসব নিয়ে জাতীয় জরিপ বা গবেষণাভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। হৃদরোগ নিয়ে জাতীয় কর্মকৌশলও নেই।
দেশের গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা নির্ভর করছেন সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত সংখ্যার ওপর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণ হৃদরোগ। বিশ্বে প্রতিবছর আনুমানিক এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ ৮৩ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যা মোট মৃত্যুর ৩৬ শতাংশ।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ হৃদরোগী হার্ট অ্যাটাকের পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়।
অর্থাৎ যখন করোনারি ধমনিতে চর্বি জমে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়ে এরই মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।
চিকিৎসকরা জানান, যখন ওষুধ বা অন্য কোনো উপায়ে হৃদরোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না, তখন ওপেন হার্ট সার্জারি, বাইপাস সার্জারি ও ত্রুটিপূর্ণ হার্ট ভাল্ভ মেরামত বা প্রতিস্থাপন করতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া জন্মগত হৃদরোগ, এওর্টার মতো বড় রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা প্রসারিত হলে এবং গুরুতর হার্ট ফেইলিউর হলে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হতে পারে।
সরকারি তথ্য বলছে, সারা দেশে ৩৪টি কেন্দ্রে হৃদরোগের অস্ত্রোপচার হয়। এর মধ্যে ২৬টি কেন্দ্রই ঢাকা শহরে। আর দেশের ৯৫ শতাংশ অস্ত্রোপচার হয় ঢাকায়। সারা দেশে পরিকল্পিত অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতি এমন হতো না।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান বলেন, ‘দেশে হৃদরোগের চিকিৎসায় ঘাটতি রয়েছে। সেসব ঘাটতি পর্যালোচনা করেই আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। কিভাবে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায় সেদিকে আমাদের বেশি নজর দিতে হবে। আমাদের চিকিৎসাসেবায় সমস্যার তুলনায় সমন্বয়ের অভাব বেশি। সংকট নিরসনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বয় করা জরুরি।’
বিদেশে যারা চিকিৎসা নেয় তার মধ্যে ১২ শতাংশ হৃদরোগী
চিকিৎসার জন্য বিশ্বের যেসব দেশের মানুষ বেশি বিদেশে যায় ওই তালিকার দশম স্থানে আছে বাংলাদেশ। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া এক হাজার ১৯৬ জনের ওপর সম্প্রতি পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছে হদরোগের অস্ত্রোপচারের জন্য, যা মোট রোগীর ১২.২০ শতাংশ। এ ছাড়া চোখের চিকিৎসার জন্য যায় ১০.৫৩ শতাংশ, কিডনির সমস্যায় ৮ শতাংশ, বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের জন্য ৭.৫২ শতাংশ, ফ্রাকচার নিয়ে ৭.৫২ শতাংশ, হাড়ের সমস্যায় ৬.৯৩ শতাংশ। এ ছাড়া লিভার, ডায়াবেটিস ও গাইনি সমস্যা নিয়েও রোগীরা বিদেশে যাচ্ছে।
ইউনাইটেড হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. সাইদুর রহমান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত শতকের আশির দশকে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে জাপানি কার্ডিয়াক সার্জারির সাহায্যে বাংলাদেশে কার্ডিয়াক সার্জারির সূচনা হয়। তখন হার্টের চিকিৎসা একদম প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অধ্যাপক এস আর খান ও অধ্যাপক নবী আলম খান প্রথম কার্ডিয়াক সার্জারি শুরু করেন। এ কারণে দেশে তাঁদের কার্ডিয়াক সার্জারির পিতা বলা হয়। প্রথমদিকে হৃৎপিণ্ডের শল্যচিকিৎসকদের প্রতি মানুষের আস্থা অনেক কম ছিল। বর্তমানে মৃত্যুর হার ১ শতাংশের কম। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না।’
তিনি বলেন, ‘হার্টের বিভিন্ন ধরনের রোগ আছে, সবচেয়ে বেশি হয় রক্তনালির ব্লক, এরপর হার্টের ভালেভর রোগ ও জন্মগত হার্টের ত্রুটি। সব কটির অপারেশন বাংলাদেশে হচ্ছে এবং মৃত্যুর হার নেই বললেই চলে।
বছরে দেশে জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্ম নেয় ৭৩ হাজার শিশু
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৭৩ হাজার শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশুকে দ্রুত চিকিৎসা না দিলে ঝুঁকিপূর্ণ জটিলতা দেখা দেয়। অধ্যাপক এস আর খান বলেন, ‘একটা হার্টের ভালেভর দাম এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা, যা বেশির ভাগ রোগীর সামর্থ্যের বাইরে। এ জন্য আমাদের রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগটি প্রতিরোধে গুরুত্ব দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনাই হৃদরোগ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। স্বাস্থ্যকর খাদ্য খাওয়া—যেমন, তাজা শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ খেতে হবে। লবণ, চিনি, তেল, ছানা, মিষ্টি, প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত ১২০ ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়ে হাঁটতে হবে। সুযোগ থাকলে অন্যান্য কায়িক পরিশ্রম ও ব্যায়াম এবং নিয়মিত খেলাধুলা করা উচিত। তামাক বর্জন ও ওজন নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। জর্দা ও অন্যান্য তামাকজাতীয় দ্রব্য, অ্যালকোহল, ইয়াবা, এনার্জি ড্রিংকস সম্পূর্ণ বর্জন করুন।’