
ব্যাংক খাতের সংস্কার ত্বরান্বিত করতে বেসরকারি ব্যাংকের পর এবার রাষ্ট্রায়ত্ত দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দুর্বল কোনো ব্যাংককে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে না, কারণ সোনালী ব্যাংকের যথেষ্ট তারল্য রয়েছে।
জানা যায়, ব্যাংক খাত সংস্কার নিয়ে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ সুপারিশ তুলে ধরেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত সেই বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা, অর্থ সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে গভর্নর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। একীভূত প্রক্রিয়া এখন অগ্রসর পর্যায়ে রয়েছে। দুর্বল কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ১৮টি ব্যাংক থেকে ২০২৫ সালে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২টিতে। আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ, কেলেঙ্কারি, অনিয়মের কারণে খাতটি চরম দুরবস্থায় পড়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা থেকে খেলাপি ঋণ ২০২৫ সালের মার্চ শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকায়। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট খেলাপি ঋণের ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ। কিছু সরকারি ব্যাংকের মোট ঋণের ৭৫ শতাংশ খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ৭০ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ৭৫ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৯ হাজার ৭২১ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকের ১৯ হাজার ৯১ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ১৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিষয়ে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। দুর্বল কোনো ব্যাংককে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে না, কারণ সোনালীর তারল্য যথেষ্ট। একীভূত হওয়ার পর নতুন প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিকভাবে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্তভাবে পরিচালনা করতে হবে। নিয়োগ ও ছাঁটাইয়ের ক্ষমতা থাকবে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার হাতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৬৬ শতাংশ। গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ তাদের প্রদত্ত ঋণের প্রায় ৭২ শতাংশ। এই পাঁচ ব্যাংক একীভূত করতে সরকার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে এবং আরও প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপোজিটরি ইনস্যুরেন্স ফান্ড থেকে। নতুন প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো পরিচালিত হবে এবং আগামী তিন বছরের মধ্যে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বিক্রির লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়া হবে।