Image description
রোহিঙ্গা ঢলের ৮ বছর আজ । উল্টো বাড়ছে দিনদিন, চলছে শুধুই আলোচনায় ।

রোহিঙ্গাদের ঢল নেমে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার আট বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। গত আট বছরে নানান ধরনের আলোচনা ও কথাবার্তা হলেও ফেরানো যায়নি একজন রোহিঙ্গাকেও। উল্টো দিনদিন বাড়ছে রোহিঙ্গার সংখ্যা। প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা এখন গলার কাঁটা হয়ে আছে বাংলাদেশের ওপর। এখনো বাংলাদেশে আসার অপেক্ষায় সীমান্তের ওপারে আছে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। তারা ঢুকেও যাচ্ছে বিভিন্নভাবে। এর মধ্যে গত আট বছরের মতোই এখনো চলছে আলোচনা। বর্ষপূতি উপলক্ষে গতকাল থেকে কক্সবাজারে হচ্ছে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সেমিনার। অন্যদিকে ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গারা জড়াচ্ছে নানামুখী অপরাধে, কেউ কেউ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কক্সবাজারকে ক্রাইম জোনে পরিণত করে এখন পুরো অঞ্চল অশান্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন, আট বছর আগে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই সীমান্ত খুলে দিয়েছিল বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার। তখন থেকে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সুযোগসুবিধা নিশ্চিতের চেষ্টা করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কোষাগার থেকে রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করা হয় এক লাখ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য আসা রোহিঙ্গাদের আরও ভালো থাকার সুযোগ সৃষ্টির জন্য শত শত বিদেশি সংস্থাকেও কাজ করার অবারিত স্বাধীনতা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন সময়। পাশাপাশি রোহিঙ্গা কূটনীতি নিয়েও আন্তর্জাতিক তৎপরতায় অস্থায়ী ক্যাম্প চিরস্থায়ী হচ্ছে বলেও অভিযোগ এসেছে। রোহিঙ্গাকে দেখতে একের পর এক বিদেশি এলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় কোনো আলোচনাতেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতির জটিলতায় এখন ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনাই প্রায় বন্ধ। কমতে কমতে প্রায় তলানিতে ঠেকেছে আন্তর্জাতিক অর্থ সাহায্য। মার্কিন প্রশাসনের নতুন সিদ্ধান্তের পর আরও বিপাকে রয়েছে রোহিঙ্গাদের তত্ত্বাবধান করা জাতিসংঘ সংস্থাও।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। এরপরও বিভিন্ন ধাপে এসেছে আরও কয়েক লাখ। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি। এখন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে। তাদের ফেরত পাঠাতে ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কিন্তু তারা যেতে না চাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরও আরেক দফা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভ-সমাবেশের কারণে সে দফাতেও প্রত্যাবাসন ভন্ডুল হয়ে যায়। দুই দফাতেই শুধু মুখের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ করেই নিজ দেশে ফিরে যাওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া ও সেজন্য কোনো ধরনের চাপ অনুভব না করা রোহিঙ্গারা যারপর নেই খুশি। এরপর থেকে নতুন কোনো প্রত্যাবাসন উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা দায়ের করে গাম্বিয়া। সেই মামলায় হেগ শহরে আইসিজের শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে লড়তে হাজির হয়েছিলেন অং সান সুচি। কিন্তু সেই মামলার পরও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও নানামুখী স্বার্থের কারণেই আটকে গেছে রোহিঙ্গা সংকট। চীনের কারণে শুরু থেকেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ-মিয়ানমারের আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু ফেরত পাঠানো যায়নি একজনকেও। আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি প্রতিবেশী ভারতের কাছে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আশ্বাস পেলেও ভারত এখন পর্যন্ত এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। অনেক ক্ষেত্রে তারা ভোটদানে বিরত থাকলেও বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়নি। শুরু থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সোচ্চার পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি ছাড়া প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে। আর পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়ে কোনো গা করছে না মিয়ানমার। এই অবস্থায় পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বরং বাংলাদেশকে আরও কিছু বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। সর্বশেষ মিয়ানমারের জন্য মানবিক করিডরের মতো প্রস্তাবও এসেছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে। রোহিঙ্গাদের দাবি, মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি নেই, নেই মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। তারা আশঙ্কা করে, ফিরে গেলে আবারও নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হতে হবে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোও একই সুরে বলছে রাখাইনে এখনো সহিংসতা বিদ্যমান; সেখানে ফেরত যাওয়া মানে আবারও অনিশ্চয়তার মুখে ফেলা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বহুমাত্রিক চাপ বাড়াতে হবে। চীনের পাশাপাশি জাপান, ভারতও মিয়ানমারকে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ভারত ও জাপান যদি মিয়ানমারের কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়, তখন চীনের এককভাবে মিয়ানমারের পক্ষে থাকা কষ্টকর হবে।