Image description

মারিয়া হাসান। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সিগারেটে আসক্ত মারিয়া। ২০২৩ সালে তার খালাতো বোন যুক্তরাজ্য থেকে ঢাকায় আসেন। বোনের মাধ্যমেই বনানীর ১১ নম্বর সড়কের একটি সিসা লাউঞ্জে গিয়ে সিসা সেবনের হাতেখড়ি তার। প্রথমদিনই তিনি সিসা সেবন করে সিগারেটের চেয়ে বেশি অনুভূতি পান। তারপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত বনানী এলাকার বিভিন্ন সিসা লাউঞ্জে গিয়ে সিসা সেবন করেন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ঢাকায় অধিকাংশ সিসা লাউঞ্জে আমার যাওয়া হয়েছে। আইনের তোয়াক্কা না করেই এসব সিসা লাউঞ্জগুলো নিকোটিন দেয়। কারণ বৈধভাবে যে পরিমাণ নিকোটিনের কথা বলা হয়েছে, সেটি দিয়ে সিসা লাউঞ্জ চলবে না। ক্রেতা যাবে না। এ ছাড়া সিসা লাউঞ্জে বিদেশিদের যাতায়াত বেশি। তারাও দেশের আইনে যে নিকোটিন প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে সেটিতে সন্তুষ্ট না।  শুধু মারিয়া নন দেশে যারা সিসার নেশায় বুঁদ হয়েছেন এমন অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় বনানী এলাকার ১১ নম্বর রোড সিসা লাউঞ্জের জন্য পরিচিতি পেয়েছে। এর বাইরে গুলশান, ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকায় সিসা লাউঞ্জ রয়েছে। সবক’টি সিসা লাউঞ্জ রেস্টুরেন্ট ব্যবসার আড়ালেই চলে। আর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরাই বেশি আসা-যাওয়া করেন। এর বাইরে মধ্য বয়স্ক ও বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশিরাও নিয়মিত যান। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সিসা লাউঞ্জ নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রতি কড়া নির্দেশনা থাকলে নামে-বেনামে ঢাকায় অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য সিসা লাউঞ্জ। উচ্চবিত্ত ঘরের মানুষ ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ- তরুণীদের টার্গেট করেই সিসা লাউঞ্জের ব্যবসায় মনোযোগ দিচ্ছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক ও পুলিশের কর্মকর্তাদের অন্ধকারে রেখে দিব্যি অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। একাধিকবার অভিযান চালিয়ে সুবিধা করা যায়নি। অভিযানে অনেক সময় অনেক সিসা লাউঞ্জ বন্ধ করে দেয়া হলেও পরবর্তীতে স্থান পরিবর্তন করে ভিন্ন নামে আবার ওই ব্যবসায়ীরা ব্যবসা শুরু করেন। সরকারি হিসাবে এখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উত্তরের আওতাধীন এলাকায় ২১টি সিসা লাউঞ্জের অস্তিত্ব মিলেছে। তবে এই হিসাবের বাইরে গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় অন্তত শতাধিক সিসা লাউঞ্জ রয়েছে। যেসব ব্যবসায়ী সিসা লাউঞ্জের সঙ্গে যুক্ত তারা প্রায় সংঘবদ্ধভাবে বিভিন্ন এলাকায় এই ব্যবসা করছেন। অভিযোগ আছে, যারা এই ব্যবসা করছেন তারা অভিজাত এলাকার প্রভাবশালী। সরকারি অভিযান, নোটিশ দিয়েও এসব বন্ধ করা যাচ্ছে না। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, অভিজাত হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্ট, এমনকি আবাসিক ভবনেও সিসা লাউঞ্জ রয়েছে। বহু বছর ধরে উচ্চবিত্তের একশ্রেণির মানুষ ও উঠতি তরুণ-তরুণীরা সিসাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় দিন দিন এটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সিসা লাউঞ্জগুলোতে মিলছে মদ, বিয়ার, ইয়াবা ও আইসের মতো ভয়ঙ্কর সব মাদকও। অন্যদিকে এটি লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় প্রভাবশালীরা ঝুঁকছেন সিসা লাউঞ্জ করার পেছনে। ফলে একাধিকবার অভিযান চালানোর পরও অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে আবারো চালু হয়ে যায় এগুলো। এতে করে রাজধানীর অভিজাত এলাকাসহ সারা দেশেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সিসা লাউঞ্জ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা আছে, শূন্য দশমিক ২ শতাংশের বেশি নিকোটিনযুক্ত যেকোনো তরল বা পানীয় ‘খ’ শ্রেণির মাদক। সিসা বিভিন্ন ধরনের ভেষজের নির্যাস সহযোগে ০.২ শতাংশের বেশি নিকোটিন এবং এসেন্স ক্যারামেল মিশ্রিত স্লাইস দিয়ে তৈরি। ফলে এটি বহন, সংরক্ষণ ও ক্রয়-বিক্রি করার অপরাধে এক বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে নিকোটিনের পরিমাণ ০.২ শতাংশেরও কম হলে ডিএনসি’র কিছুই করার থাকবে না। অধিদপ্তর জানিয়েছে, আইন অনুযায়ী ০.২ শতাংশের বেশি নিকোটিনযুক্ত সিসা অবৈধ। কিন্তু এ পর্যন্ত ডিএনসি’র রাসায়নিক পরীক্ষাগারে যতগুলো আলামত পরীক্ষা করা হয়েছে কোনোটিতেই ০.২ শতাংশের নিচে নিকোটিন মেলেনি। ডিএনসি সূত্র জানায়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ডিএনসি’র কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে ৯টি পৃথক আলামত পরীক্ষা করা হয়। প্রতিটিতেই শূন্য দশমিক ২ শতাংশেরও বেশি নিকোটিন পাওয়া যায়। এমনকি সেপ্টেম্বরের পরে যে ১০টি মামলা হয়েছে- সেগুলোর আলামত পরীক্ষাতেও ০.২ শতাংশের কম নিকোটিন পাওয়া যায়নি। এর আগে ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে ১৯টি লাউঞ্জের সিসায় মাত্রাতিরিক্ত নিকোটিন থাকার প্রমাণ মিলেছিল। এর মধ্যে ছিল বনানীর থার্টি টু ডিগ্রি, হেজ রেস্টুরেন্ট, আরগিলা রেস্টুরেন্ট, আল গেসিনো ও কিউডিএস এবং গুলশানের মনটনা লাউঞ্জ। ডিএনসি জানায়, সিসার ফ্লেভারে রয়েছে নিকোটিন। ‘লেডি কিলার’, ‘লাভ সিক্সটি সিক্স’, ‘হ্যাভানা লাইট’, ‘অরেঞ্জ মিন্ট’ ও ‘স্ট্রবেরি’-সব ফ্লেভারেই মেলে ০.৫ শতাংশ নিকোটিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বয়হীনতার অভাবে এগুলোকে দমাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। উল্টো দিন দিন এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে। কোনো কোনো সিসা বার বা লাউঞ্জ সারারাত খোলা থাকছে। যেখানে হুক্কার পাইপের মাধ্যমে সিসা টেনে ধোঁয়া ছেড়ে উল্লাসে মাতছেন তরুণ-তরুণীরা। 

ডিএনসি’র হিসাবে যে ২১টি সিসা লাউঞ্জের নাম পাওয়া গেছে সেগুলো হলো- গুলশান-২ এর মনটানা লাউঞ্জ, কোট ইয়ার্ড বাজার, আল গেসিনো, আরগিলা রেস্টুরেন্ট, থার্টি টু ডিগ্রি, কিউডিএস, সেলসিয়াস, এমব্রেলা লাউঞ্জ, ক্যাফে এক্সিল, ক্যাফে লাউঞ্জ, দ্যা সিলভার লাউঞ্জ, জাজ লাউঞ্জ, সিগনেচার লাউঞ্জ, হবনব রেস্টুরেন্টস, ক্লাব-৯২৯৪, ৩৬০ ডিগ্রি, ওরা, এয়া হাবিবি, এক্সোটিক, সাইম লাউঞ্জ, হ্যাভানা ক্যাফে অ্যান্ড লাউঞ্জ। 

ডিএনসি সূত্র জানায়, সমপ্রতি রাজধানীর ১২টি সিসা লাউঞ্জ বা বারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে মামলা করা হয়। এর মধ্যে ৯টি সিসা লাউঞ্জই বনানী এলাকার। গত বছরের ১লা অক্টোবর বনানীর ১২/বি রোডের ৭৭ নম্বর বাড়ির ১০ তলায় অবস্থিত আল গ্রিসিনো রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনা করে ৫ কেজি ২১৪ গ্রাম সিসা ও দুটি হুক্কা উদ্ধার করা হয়। পরে লাউঞ্জটির ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম ও শিমু নামে একজনের নামে বনানী থানায় মামলা দায়ের করা হয়। একই দিন ১১ নম্বর রোডের ১০০ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত এরাবিয়ান কেজি নামে একটি সিসা লাউঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে ৩.৪ কেজি সিসা ও দুটি হুক্কা উদ্ধার করে ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ওইদিনই বনানীর ১১ নম্বর রোডেই আনজারা ভবনের ৫ তলায় অবস্থিত সেলসিয়াস নামে অন্য একটি সিসা লাউঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে ২২০ গ্রাম সিসা ও দুটি হুক্কা উদ্ধার করে ৩ জনের নামে মামলা করা হয়। গত ৬ই জানুয়ারি আবারো চালু হওয়া এরাবিয়ান কোজি রেস্টুরেন্ট থেকে ৪ কেজি সিসা, ৬ ক্যান বিয়ার ও ১১টি হুক্কা উদ্ধারের পর ৬ জনের নামে মামলা করা হয়। গত ২৪শে জানুয়ারি বনানী ৭ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত ক্লাব ৯২৯৪ লিমিটেডে অভিযান পরিচালনা করে ৪ কেজি সিসা, ১০টি হুক্কা ও ৬ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধারের পর ৩ জনের নামে মামলা করা হয়। গত ১১ই মার্চ বনানী ১১ নম্বর রোডের ৬৭/ডি নম্বর বাড়িতে অবস্থিত হেইজ নামে একটি সিসা লাউঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে ৫ কেজি সিসা ও ৪টি হুক্কা উদ্ধারের পর একজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করা হয়। একইদিন বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের তানিম স্কয়ারের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত হবনব নামে একটি সিসা লাউঞ্জ থেকে ৬ কেজি ২০০ গ্রাম সিসা ও ৪টি হুক্কা উদ্ধারের পর একজনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করা হয়। গত ৮ই এপ্রিল ধানমণ্ডির ওজং রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে ৩ কেজি ৯৯০ গ্রাম সিসা ও ২০টি হুক্কা উদ্ধারের পর ৬ জনের নামে মামলা করা হয়। গত ১৬ই মে বনানীর হেইজ সিসা লাউঞ্জে আবারো অভিযান পরিচালনা করে ৭ কেজি সিসা ও ২৬টি হুক্কাসহ বিভিন্ন জিনিস জব্দ করে ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। গত ২৮শে মে বনানীর দি সিলভার লাউঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে ৫ কেজি সিসা ও ১৩টি হুক্কা জব্দ করে ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উত্তরের উপ-পরিচালক শামীম আহম্মেদ মানবজমিনকে বলেন, সিসা লাউঞ্জের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করেছি। অন্যসব সংস্থাও মামলা করতে পারবে। তবে অভিজাত এলাকায় প্রভাবশালীরা এই ব্যবসা করেন। অভিযান চালিয়ে বন্ধ করতে গেলে বিভিন্ন বাধা আসে। তবুও আমরা অসংখ্য লাউঞ্জ বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু পরে তারা আবার অন্য জায়গায় ব্যবসা শুরু করেছে। শুধুমাত্র সিটি করপোরেশন থেকে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে তারা লাউঞ্জ চালায়। তিনি বলেন, আমরা অভিযানে গিয়ে অনেক বিদেশি নাগরিককে সিসা সেবন করতে দেখেছি। অভিযান চালানোর সময় তারা সেটিকে হয়রানি মনে করে। বনানীর একটি বহুতল ভবনে এরাবিয়ান  কোজি নামে সিসা লাউঞ্জ পরিচালনার সময় দুবার অভিযান পরিচালনা করে ডিএনসি। এরপর ‘৩৬০ ডিগ্রি’ নামে আবারো চালু হয় সিসা বারটি।