
সরব আন্দোলন আর নীরবে নির্বাচনের প্রস্তুতি-এই দুই কৌশলে এগোচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি সোচ্চার থাকলেও নির্বাচনের পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। প্রায় ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাই করার পর শীর্ষ থেকে তৃণমূল সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা নির্বাচনী তৎপরতায় সক্রিয় আছেন মঞ্চ-ময়দানে। দলের দায়িত্বশীল সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার জানান দিচ্ছে জামায়াত। একই সুর উচ্চারিত হচ্ছে ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ তাদের সমমনা কয়েকটি দলের কণ্ঠেও। আলোচ্য পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে ইতিমধ্যে একাধিক কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াত। এই দাবি পূরণ না হলে নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না-এমন কথাও বলছেন এসব দলের কোনো কোনো নেতা। তবে প্রকাশ্যে এ ধরনের শক্ত ভাষা ব্যবহার করলেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে দলের ভেতরে নমনীয়তা আছে বলে সূত্র জানায়।
সরজমিন চিত্রও তাই বলে। যেমন ঢাকা-১৫ আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী দলটির আমীর ডা. শফিকুর রহমান। গত ২রা আগস্ট রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে বাইপাস সার্জারির পর বর্তমানে বাসায় বিশ্রামে আছেন তিনি। তার পক্ষে এ আসনে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত আছেন দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। সর্বশেষ গত ১৮ই আগস্ট মিরপুর-১৩ এর ৪ নং কমিউনিটি সেন্টারে মহিলা সমাবেশ করে জামায়াত। ঢাকা মহানগর উত্তরের নায়েবে আমীর আব্দুর রহমান মুসার সভাপতিত্বে সহকারী সেক্রেটারি ডা. ফখরুদ্দিন মানিকের পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম প্রমুখ। বক্তারা ডা. শফিকুর রহমানের পক্ষে ভোট চেয়ে বলেন, তিনি শুধু জামায়াতের আমীরই নন, তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত, গ্রহণযোগ্য ও আস্থাভাজন ব্যক্তি। একজন শীর্ষস্থানীয় জাতীয় নেতা হয়েছেন। সংকটময় মুহূর্তে তিনি দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আশা করছি সবার সহযোগিতা এবং দোয়া নিয়ে ইনশাআল্লাহ তিনি এখানে বিজয় লাভ করবেন। কয়েক হাজার নারীকর্মী সমর্থক এ সমাবেশে যোগ দেন। জানা যায়, এমনিভাবে সারা দেশে নির্বাচনী তৎপরতায় ব্যস্ত সময় পার করেছেন জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
এদিকে জুলাই সনদ ও পিআর বিতর্কে সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠ জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। শুক্রবার কুমিল্লা মহানগর জামায়াত আয়োজিত নির্বাচনী দায়িত্বশীল সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, আমরা একটি অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। স্বৈরাচার ছাড়া সব বৈধ দলের অংশগ্রহণে হবে এই নির্বাচন। এর আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কারের অনেক বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য পোষণ করেছে। এ সংস্কারের ভিত্তিতেই নির্বাচন হতে হবে। এ সংস্কারের ভিত্তিতে নির্বাচন হতে হলে সংস্কারের একটি আইনি ভিত্তি তৈরি করতে হবে। একইসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন জরুরি। তিনি বলেন, আমরা বিএনপি’র বাইরে যতগুলো দল আছে, সবাই মিলে একটি সমঝোতার নির্বাচনের চেষ্টা করছি, তবে সেখানে জাতীয় পার্টিকে যুক্ত করা হবে না। কুমিল্লা মহানগর জামায়াতের আমীর কাজী দ্বীন মোহাম্মদের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য অধ্যাপক লিয়াকত আলী ভূঁইয়া, কুমিল্লা মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমীর মু. এ কে এম এমদাদুল হক মামুন, সহকারী সেক্রেটারি কামারুজ্জামান সোহেল, মোশারফ হোসাইন, নাছির আহম্মেদ মোল্লা প্রমুখ।
গত ৫ই আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেন। এরপরই শুরু হয় জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ নিয়ে বিতর্ক। যা আলোচনার টেবিল থেকে ছড়িয়ে পড়ে রাজপথে। এই বিতর্কে নিষ্পত্তি না হলে নির্বাচন হবে না- বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তৃতা মঞ্চে এসব কথা উচ্চারিত হলেও ঘোষিত সময়সীমায় নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত জামায়াত। দলের নির্বাহী পরিষদের বর্ষীয়ান সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম বলেন, জামায়াত নির্বাচনমুখী দল। সরকার ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে যেকোনো তারিখের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত জামায়াত। তিনি বলেন, কেউ কেউ বলেন আমরা নির্বাচন ঠেকাতে অথবা পিছাতে চাই। একথা একেবারেই সঠিক নয়। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে জামায়াতের কিছু দাবি আছে, দাবি পূরণের র্স্বোচ্চ চেষ্টাও করা হবে। কিন্তু তাই বলে নির্বাচন বানচাল হোক এটা তো আমরা চাইতে পারি না। কারণ এতে তো দেশে অচলাবস্থা ও অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে- যা কারোই কাম্য নয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে খালাস পাওয়া জামায়াতের এই নেতা বলেন, বিগত প্রায় ১৬ বছর মানুষের ভোটাধিকার ছিল না। ফ্যাসিবাদের পতনের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ ভোট দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তবে সেই ভোটের আয়োজনটা যেন অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং উৎসবমুখর হয়- সেটাই আমাদের চাওয়া।
এদিকে ভোটের প্রস্তুতি চলমান রাখলেও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির দাবি থেকে এখনই সরছে না জামায়াত। তবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কিছু ছাড় দিতে রাজি আছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার রাতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নির্বাহী পরিষদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের লক্ষ্যে জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি কার্যকর করা এবং এর ভিত্তিতেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্সিয়াল প্রোক্লেমেশন অথবা গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জোর দাবি জানানো হয়।