
পোল্যান্ড প্রবাসী সিলেটের নাজমুল ইসলাম। দেশে এসে শ্বশুরবাড়ির মামলায় সাক্ষী হয়েছিলেন। আর এই সাক্ষী কাল হলো। মোটরসাইকেল চুরির মিথ্যা মামলা দিয়ে নাজমুলকে গ্রেপ্তার করে শাহপরান থানা পুলিশ। এরপর রিমান্ডের নামে নাজমুলের স্ত্রী ডা. ফাতেমা আক্তার রিয়ার কাছ থেকে লুটে নিয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার টাকা। এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ নাজমুল জামিনে বেরিয়ে এসেছিলেন দুই ওসিসহ ৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে করেছিলেন মামলা। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি খারিজ করায় তিনি বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে আপিলে জয়ী হয়েছেন। এখন মামলাটি তদন্তে গেছে। তবে; এই মামলা নিয়ে পুলিশের মধ্যে তোলপাড় চলছে। নাজমুল জানিয়েছেন, ‘তিনি আইনের কাছে বিচারপ্রার্থী। আমার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে সেটির বিচার চাইতে আইনি লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াই চলমান থাকবে। নগরের সুবহানী ঘাটের লতিফিয়া টাওয়ারের বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম। ২০২৩ সালের জুনে তিনি পোল্যান্ড থেকে সিলেটে আসেন। তিনি পোল্যান্ডের শাহীদ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দেশে ফেরার পর পাবিরবারিক কাজ থাকায় তিনি বিদেশ যেতে পারেননি। ওই সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মাঠে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে তার শাশুড়ি রুবিনা আক্তার রুবি গত বছরের ২রা অক্টোবর তার দেবর ও ভাসুরদের বিরুদ্ধে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় শাহপরান থানায় এজহার দায়ের করেন। টাকার জন্য রুবিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় দায়ের করা এজাহারে সাক্ষী হন প্রবাসী নাজমুল ও তার স্ত্রী ডা. রিয়া। কিন্তু শাহপরান থানা পুলিশ মামলা গ্রহণ না করলে পরবর্তীতে আদালতের শরণাপন্ন হন রুবি। পরে আদালতের নির্দেশে শাহপরান থানা পুলিশ ওই মামলাটি রেকর্ড করে।
মামলায় সাক্ষী হওয়ায় চাচা শ্বশুর শহরতলীর বটেশ্বরের মলাই টিলার বাসিন্দা শামসুদ্দিন কাপ্তানসহ অন্যরা ক্ষুব্ধ হন। নাজমুল জানান, তার শাশুড়ির সঙ্গে চাচা শ্বশুরদের দ্বন্দ্বে চাচা শ্বশুরদের পক্ষে অবস্থান নেন তার শ্যালক বায়েজিদ আরমান রিফাত। শাশুড়িকে তাড়িয়ে দিলেও রিফাতকে তারা নিজ বাড়িতে বসবাসের সুযোগ দেন। নাজমুল জানিয়েছেন, তিনি প্রবাসী হওয়ায় তার বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল না। দেশে ফেরার পর যাতায়াতের সুবিধার্থে তিনি তার শ্যালক রিফাতের আইডি কার্ড ব্যবহার করে নগরের শিবগঞ্জের আয়েশা লেইস মটরস থেকে একটি মোটরসাইকেল ক্রয় করেন। মামলার সাক্ষী হওয়ার পর তার চাচা শ্বশুরদের ইন্ধনে শ্যালক রিফাত মোটরাসাইকেলটি চুরি হয়েছে দাবি করে শাহপরান থানায় গত বছরের ১৭ই অক্টোবর একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। নাজমুল জানান, মামলা দায়েরের আগে আমি ও আমার স্ত্রী শাহপরান থানায় গিয়ে ওসি মনির হোসেনকে সবকিছু দেখাই। মোটরসাইকেল হস্তান্তরের চুক্তিও দেখানো হয়। এরপরও ওসি মনির আমার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলা রেকর্ড করেন। এদিকে, মামলা রেকর্ডের পর পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার এসআই অঞ্জন কুমার দেবনাথ ও আরেক এসআই মিজানুর রহমান গ্রেপ্তারের ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রবাসী নাজমুলের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে ২৭ হাজার টাকা নেন। এই অবস্থায় ওসির নির্দেশে ওই বছরের ৪ঠা নভেম্বর নাজমুলকে সুরমাগেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ মামলায় রিমান্ডে এনে নির্যাতনের কথা বলে নাজমুলের স্ত্রী ডা. রিয়ার কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন এসআই অঞ্জন ও এএসআই ইমরান বিন রাজ্জাক। পরবর্তীতে ডা. রিয়া স্বামীকে নির্যাতন থেকে বাঁচাতে দুই লাখ টাকা প্রদান করেন। কিন্তু কথামতো ৫ লাখ টাকা না দেয়ায় পরবর্তীতে আদালতে রিমান্ডের আবেদন জানান তদন্ত কর্মকর্তা। তবে পারিবারিক বিরোধ হওয়ায় শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করেন। এ সময় এক আদেশে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তার পর্যবেক্ষণে জানান এ মামলাটি পারিবারিক বিরোধ ও শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ।
অন্য এক আদেশে ম্যাজিস্ট্রেট উল্লেখ করেন; মামলায় উল্লেখিত মোটরসাইকেল সংক্রান্ত কথিত জাল-জালিয়াতি কাগজ দাখিল করা হয়েছে তা স্বীকৃত। এ মামলা থেকে ২৫শে নভেম্বর জামিন পান প্রবাসী নাজমুল ইসলাম। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে প্রবাসী নাজমুল পুলিশের সীমাহীন দুর্নীতি, হুমকি, মিথ্যা মামলা দায়ের এবং একপেশে আচরণের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন। সার্বিক বিষয় জানিয়ে তিনি সিলেটে পুলিশ কমিশনারকে বিষয়টি অবগত করেন। পরে চলতি বছরের ১৪ই জানুয়ারি তিনি বাদী হয়ে পুলিশসহ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতে মামলা করেন। কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করায় শুনানি শেষে আদালত তার মামলাটি খারিজ করে দেন। পরে তিনি এ নিয়ে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন। মহানগর আদালত আপিল শুনানির জন্য এজহারটি বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে প্রেরণ করেন। পরে শুনানি শেষে গত ১৭ই আগস্ট মামলা গ্রহণ করতে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে নির্দেশ দেন ওই আদালতের বিচারক এম আলী আহমদ।
বিভাগীয় জজ আদালতের পেশকার জামিল আহমদ গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, মামলা গ্রহণ করে তদন্তে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এদিকে, মামলায় আসামি করা হয়েছে-শাহপরান থানার ওসি মনির হোসেন, তৎকালীন ওসি তদন্ত ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য, তৎকালীন এসআই ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অঞ্জন কুমার দেবনাথ, তৎকালীন এসআই মিজানুর রহমান, এএসআই ইমরান বিন রাজ্জাক, বটেশ্বর মলাই টিলার বাসিন্দা বায়েজিদ আরমান রিফাত, শামসুদ্দিন কাপ্তান, মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জুল, আশরাফ উদ্দিন মাসুম ও তাদের বোন রোকেয়া পারভীনকে। মামলার বাদী প্রবাসী নাজমুল জানিয়েছেন, ‘আমাকে চোর সাজিয়ে গ্রেপ্তার করে কারান্তরীণ করা হয়েছে। রিমান্ডে এনে নির্যাতনের কথা বলে চাঁদাবাজি করা হয়েছে। সামাজিকসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় আমাকে চোর আখ্যা দিয়ে অপপ্রচার করা হয়েছে। পারিবারিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ওসি মনির টাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠায় তিনি আমার সঙ্গে একের পর এক অপকর্ম করেছেন। এখন আমি এর বিচার চাই। এ কারণে আদালতে মামলা করেছি।