Image description
শতাধিক মৃত্যু

বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দেশ জুড়ে ভাইরাস জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। জ্বর, সর্দি-কাশি প্রায় ঘরে ঘরে। তীব্র জ্বরে শরীর কাবু করে ফেলায় অনেকে চিকিৎসা নিতে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন। মশার প্রজনন মৌসুম চলায় অনেকে ডেঙ্গু মনে করে আরও বেশি আতঙ্কিত। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কারও চিকুনগুনিয়া, করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। একই রকম উপসর্গ হওয়ায় চিকিৎসা দিতে সমস্যায় পড়ছেন চিকিৎসকরা। সরকারি হিসেবে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু ১১০ জন এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময় ভাইরাসজনিত জ্বরের জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল বলে ধরা হয়। করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড ও মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ। চার থেকে পাঁচদিনের জ্বর নিয়ে আসছেন রোগীরা। একজনের জ্বর হলে পরিবারের অন্যরাও জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। উপসর্গও প্রায় একই রকম। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ ভাইরাস ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত জ্বরে। তাদের পরামর্শ, হালকা উপসর্গ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে ঘরে বিশ্রাম নিতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, মাস্ক পরা ও গরম তরল খাবার খেতে হবে। 

কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার তাদের গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন,  ডেঙ্গুতে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে দেশের অনেক জেলায় পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্দেশক ‘ব্রেটো ইনডেক্স’ ২০-এর উপরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কোনো এলাকায় যদি এ সূচক ২০ ছাড়িয়ে যায়, তাহলে সেই এলাকায় ডেঙ্গুর মতো রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি। বর্তমানে বরিশাল বিভাগ, বিশেষ করে বরগুনা ও বরিশাল জেলার অবস্থা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমাদের গবেষণা ফোরকাস্টিং মডেলের ভিত্তিতে বলা যায়, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, গাজীপুর, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর ও মাদারীপুর জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক রূপ নিতে পারে। কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ডেঙ্গু প্রবৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে বাড়বে, যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

আগস্টের শুরু থেকে সর্দি-কাশি-জ্বর নিয়ে দু’সপ্তাহ ভুগেছেন আজিমপুরের হান্নান মিয়া। দু’দফা গিয়েছেন সরকারি কর্মচারী হাসপাতালেও। জ্বর কমলেও চিকিৎসকরা কাশি কমানোর জন্য তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন। কিন্তু শরীর খুবই দুর্বল বলে জানান তিনি। চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন এটা সিজনাল জ্বর। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফারুক আহাম্মদ বলেন, আমরা দিনে গড়ে এক হাজার ২০০ রোগী দেখছি, যার একটি বড় অংশ ভাইরাস জ্বর, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। প্রায় সবারই জ্বর, কাশি, শরীর ব্যথা ও দুর্বলতা। রোগী সামলানো ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে সংকটে পড়ছি। জ্বর আসলে কোনো রোগ নয়, বরং এটি রোগের একটি লক্ষণ বা উপসর্গ। অনেকগুলো কারণে জ্বর হতে পারে। সবচেয়ে কমন হলো ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হওয়া বা সর্দি-কাশির কারণে জ্বর। এর বাইরে শরীরের ভেতরে কোনো কারণে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণ হলে। অর্থাৎ ইনফেকশন হলে জ্বর হতে পারে। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এই সময়ে ছয় ধরনের জ্বর হচ্ছে। তবে তিন ধরনের জ্বর আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও করোনা। আর অন্য তিনটা জ্বর হলো- শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত জ্বর, পানিবাহিত সংক্রমণজনিত জ্বর এবং টাইফয়েড বা প্যারা টাইফয়েড জ্বর। এই তিন সংক্রমণে মধ্যম মানের জ্বর থাকে। আর ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াতে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয় এবং চিকুনগুনিয়াতে ব্যথা সবচেয়ে বেশি থাকে। করোনায় আবার কাশি ও শ্বাসের টান থাকে, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াতে কাশি বা শ্বাসের টান সাধারণত থাকে না। করোনাতে গলাব্যথা থাকতে পারে কিছুটা, চিকুনগুনিয়াতে আবার গলাব্যথা থাকে না। অন্যদিকে করোনাতে নাকে গন্ধ এবং মুখে স্বাদ না-ও পেতে পারে। কিন্তু চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুতে এটি হয় না। চিকুনগুনিয়াতে শরীরের জয়েন্টে এত বেশি ব্যথা হয় যে, অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে হাঁটতে পারে না, কাউকে ধরে তাকে হাঁটাতে হয়। ডেঙ্গুতে ব্যথা হয় কিন্তু তীব্র ব্যথা হয় না। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুতে রোগী প্রচণ্ড দুর্বল বোধ করে, সে তুলনায় করোনায় প্রথমদিকে দুর্বলতা কম থাকে এবং কাশি, শ্বাসের টান কম থাকে।

সমপ্রতি বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত ‘কন্টিনিউয়িং মেডিক্যাল এডুকেশন (সিএমই)’ সেশনে দেশের ভাইরাসজনিত জ্বরের সামপ্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান তার প্রেজেন্টেশনে বলেন, এখন জ্বর হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়ছে ভাইরাসঘটিত নানা রোগ। টাইফয়েড, মৌসুমি ফ্লু কিংবা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা এদের উপসর্গ একে অন্যের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষায় ফলাফল নেগেটিভ এলেও উপসর্গ থেকেই যাচ্ছে। ডা. আবেদ বলেন, ২০১৭ সালের পর ফের দেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার কম হলেও রোগের পর দীর্ঘমেয়াদি উপসর্গ যেমন গিঁটে ব্যথা, র‍্যাশ ও দুর্বলতা রোগীর দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই এটি সাধারণ জ্বর ভেবে অবহেলা করা উচিত নয়।