Image description
আওয়ামী সুবিধাভোগীদের নির্দেশনা বাস্তবায়নের চেষ্টা

ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ডিটেল এরিয়া প্ল্যান-ড্যাপ) সংশোধনী প্রায় চূড়ান্ত। সব ঠিক থাকলে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পেয়ে আগামী মাসে ড্যাপের সংশোধনী চূড়ান্ত হতে পারে। তবে এ সংশোধনীতেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি কোনো পক্ষ। নানা বিষয় নিয়ে এখনো আপত্তি আছে অংশীজনদের মধ্যে। অভিযোগ আছে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পাশ কাটিয়ে কিছু আওয়ামী সুবিধাভোগীদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এমনকি আগের দুই সভায় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল উপস্থিত থাকায় অনেক জনবিরোধী আইন চাপিয়ে দিতে পারেননি পরিবেশ ব্যবসায়ী আরেক উপদেষ্টা। সর্বশেষ সভায় ড্যাপে যে আইন বাস্তবায়নযোগ্য নয়; জনবিরোধী সেই আইনও চাপিয়ে দেন পরিবেশ উপদেষ্টা। শুধুমাত্র বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি প্রফেসর ড. আদিল মুহাম্মদ খানের পরামর্শে ড্যাপ সংস্কার করা হচ্ছে। যা দিয়ে রাজধানীর সাধারণ জনগনের বসবাসের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। এমনকি স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সময় এই ড্যাপ বাস্তবায়ন কমিটিতে ছিলেন স্থপতি ইকবাল হাবিব (পরিবেশ উপদেস্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান দেবর)। যিনি এখনও কমিটিতে বহাল আছেন। যদিও এ সংশোধনী প্রস্তুত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৭টি সভা করতে হয়েছে বলে জানা গেছে।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি আবদুল লতিফ ইনকিলাবকে বলেন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পাশ কাটিয়ে একক কর্তৃত্বে পরিবেশ উপদেষ্টা এই ড্যাপ বাস্তবায়ন করছেন। পরিবেশ উপদেষ্টা কারো কোন দাবিই আমলে নেননি। এটা পূরানো আইনের নতুন সংস্করণ। এই সংস্কার আগের থেকেও ভয়ংকর হবে। রাজধানীতে জনসাধারনের বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে কারো দাবি পূরণ করা হয়নি। বরং আগের থেকে আরও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবদুল লতিফ বলেন, যে আইন বাস্তবায়ন যোগ্য নয়; তা জনগনও মেনে নেব না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন- সিলেটের ভোলাগঞ্জে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা হয়েছিল। এখন দেখা গেছে একরাতে সব লুট হয়ে গেছে। তাই যে আইন বাস্তবায়নযোগ্য নয়; সেই আইন কোনভাবেই কাম্য নয়।

আবদুল লতিফ বলেন, এরিয়া ফার কিছুটা বেড়েছে কিন্তু রোড ফার কমিয়ে দিয়েছে। ২০ থেকে ২২ ফুটের কম প্রশস্ততার সড়কে যে এফএআর দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে। এটা ঠিক হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আমরা আবার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসব। অপরিকল্পিত এলাকার জনগণ, যাদের জন্য আমরা আন্দোলন বা দেন-দরবার করছিলাম তাদের কোনো উপকার হলো না। কারণ ডেনসিটি অলমোস্ট দুইয়ের নিচে, অর্থাৎ আপনি কাঠাপ্রতি দুইটার বেশি ফ্ল্যাট করতে পারবেন না। ৫ কাঠা জমিতে হলে আপনি সর্বোচ্চ ১০টা ফ্ল্যাট বানাতে পারবেন।

সূত্র মতে, ঢাকা মহানগর দেশের মোট আয়তনের ১ শতাংশের কাছাকাছি। যদিও শহরটিতে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশের বসবাস। ঢাকা শহর জনসংখ্যার চাপে পিষ্ট। প্রতিনিয়ত বাড়ছে এই শহরের জনসংখ্যা। জনসংখ্যার চাপে প্রতিদিনই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে রাজধানী ঢাকা। ধারণ ক্ষমতার ৩ গুন বেশি জনসংখ্যা বাস করছে। এই জনসংখ্যার দীর্ঘদিনেও রাজধানীর সুয়ারেজ লাইন ঠিক করা যায়নি। রাজধানীর বস্তি ও অবৈধ বাসা-বাড়ি, প্রায় ২০ লাখ বিদ্যুৎ চালিত অটোরিক্সার বিদ্যুৎতের হিসাব নেই। অবৈধ লাখ লাখ গ্যাস লাইনের হিসাব নেই। যারা রাজধানীতে অবৈধভাবে বসবাস করছে। একই সঙ্গে প্রায় অর্ধকোটি গার্মেন্টস কর্মী পরিবারসহ বসবাস করছে। যা রাজধানীর অতিরিক্ত চাপ। এই জনসংখ্যার চাপ পড়ছে যারা প্রতিবছর কর দিচ্ছে তাদের ওপরই। এছাড়া রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে চার নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা। শিল্প-কারখানা, মেডিকেল, শহরের পয়োনিষ্কাশন থেকে শুরু করে অবৈধ বসবাসকারীদের প্রায় সব বর্জ্যই ফেলা হচ্ছে এসব নদ-নদীতে। যা এতোটা ভয়াবহ অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে- বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরী, দূষিত নদী, জনবহুল বা বসবাস অনুপযোগী নগরীতে পরিণত হয়েছে ঢাকা। অথচ এসব বিষয়ে কোন গুরুত্ব নেই সরকারের।

বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) তৈরি করেছে। ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট নতুন ড্যাপের গেজেট প্রকাশের পর থেকেই ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই মহাপরিকল্পনা করা হয়। যদিও শুরু থেকেই এটি নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে।

ড্যাপের খসড়া পরিকল্পনায় জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়। এ জন্য বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে স্থপতি ও আবাসন ব্যবসায়ীরা তীব্র সমালোচনা করেন। পরে সেই ব্যবস্থা থেকে সরে এসে ফ্লোর এরিয়া রেশিওর (এফএআর) ভিত্তিতে ভবনের আয়তন নির্ধারণের সুপারিশ করে রাজউক। এতে ধানমন্ডি ও গুলশানের মতো পরিকল্পিত এলাকার তুলনায় অন্যান্য এলাকায় ভবনের আয়তন কমে যায়। তখন আবার সমালোচনা হলে কিছু জায়গায় সংশোধন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে রাজউক। তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এখন নতুন করে ড্যাপ সংশোধনীতে পরিবেশ উপদেষ্টার একক হস্তক্ষেপ চলমান রয়েছে। যা আরও বিপাকে ফেলবে সাধারণ মানুষের বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ড্যাপ ও ইমারত বিধিমালা সংশোধনের জন্য মোট ৩৭টি সভা হয়েছে। এর মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে ৩টি, সচিব পর্যায়ে ৪টি, মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত কমিটির ১০টি এবং রাজউকে অংশীজনদের সঙ্গে ২০টি বৈঠক হয়েছে। গতকালও গৃহায়ন ও গনপূর্ত মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়েছে। এসব বৈঠকে নানা প্রস্তাব ও মতামতের ভিত্তিতে খসড়ায় ঐকমত্যে পৌঁছানো হয়।

এতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি), বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (আইএবি) ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) ঐকমত্যের ভিত্তিতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এফএআর (ফ্লোর এরিয়া রেশিও), জনঘনত্ব ও আবাসন ইউনিটে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। তাছাড়া বন্যা প্রবাহ এলাকায় ও গ্রামীণ প্রকৃতি সব বেশ কিছু বিষয়ে সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে।
গত রোববার সচিবালয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ড্যাপের খসড়াটি অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত করা হয়। গতকালও একটি সভা হয়েছে। পরবর্তী ধাপে এটি ড্যাপ-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে পাঠানো হবে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। সব ঠিক থাকলে এক মাসের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।

বৈঠকে বিদ্যমান রাস্তার ভিত্তিতে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর), এলাকাভিত্তিক এফএআর ও জনঘনত্ব নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গ্রামীণ এলাকার (যেমন দাসেরকান্দি, কাঁচপুর, ময়নারটেক, আলীপুর, রুহিতপুর, বিরুলিয়া, বনগ্রাম ইত্যাদি) মোট ১৬টি জনঘনত্ব ব্লকের এফএআর সামান্য সমন্বয় করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও নগর এলাকার এফএআর আগের মতো বহাল থাকবে। এ ছাড়া ২০১১ সালের বিবিএস হাউজহোল্ড সাইজ বিবেচনায় আবাসন ইউনিট নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়।

তাছাড়া ড্যাপের (২০২২-৩৫) নীতিমালায় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আপডেটের বিধান থাকায় আগামী এক বছরের মধ্যে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে পরিকল্পনার উন্নয়ন ও আপগ্রেডেশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই কমিটি ঢাকার বাসযোগ্যতা বাড়াতে রাজউককে নীতি ও প্রযুক্তিগত পরামর্শ দেবে।

সংশোধিত ড্যাপের খসড়া প্রস্তাবনায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ এলাকায় এফএআর, জনঘনত্ব এবং আবাসিক ইউনিট বাড়ানো হয়েছে। তবে কিছু কিছু এলাকায় এফএআর কমানো হয়েছে। এতে কোনো পক্ষই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি।

অবশ্য রাজউকের প্রধান পরিকল্পনাবিদ এবং ড্যাপ প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া সংশোধনী নিয়ে কাজ করছে রাজউক। উপদেষ্টা পরিষদে পাস হওয়াসহ সব প্রক্রিয়া শেষ হতে এক মাসের মতো সময় লাগবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ড্যাপের কারণে আবাসনের পাশাপাশি সংযোগ শিল্পের ব্যবসায় দীর্ঘদিন থেকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে উল্লেখ করেছেন রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান। রিহ্যাব সভাপতি বলেন, আবাসন খাত ভালো থাকলে সংযোগ শিল্পগুলো স্বাভাবিকভাবেই ভালো থাকে। এখন তারাও ভালো নেই। কারণ, বৈষম্যমূলক নতুন ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে আবাসনশিল্প সমস্যায় আছে। নতুন সংশোধনী আরও বিপাকে ফেলবে এই খাতকে।

মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, নির্মাণ উপকরণের সবচেয়ে বড় উপাদান রড। কিন্তু রডের চাহিদা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। একইভাবে চাহিদা কমেছে সিমেন্ট, ইটসহ অন্যান্য উপকরণের। চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমেছে। অনেক লোকবল ছাঁটাই হয়েছে। ভবিষ্যতে অনেক প্রতিষ্ঠান সেই দিকে হাঁটবে। তিনি বলেন, বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ নিয়ে জমির মালিক, আবাসন ব্যবসায়ী ও সংযোগ শিল্পের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনতে অবশ্যই অবসান ও সংযোগ শিল্পের স্থবিরতা থেকে অতি দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে হবে। সরকারকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।

আবাসনশিল্পের কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে রড, সিমেন্ট, ইট, টাইলস, কেব্ল, রং, লিফট, থাই, স্যানিটারিসহ প্রায় ৩০০ সংযোগ শিল্প এসব খাত অর্থনীতির চাকা গতিশীল রেখেছে। এসব শিল্পে ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধের পথে বলে উল্লেখ করেন রিহ্যাব সভাপতি।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট নতুন ড্যাপের গেজেট প্রকাশের পর থেকেই আবাসন খাতের উদ্যোক্তা ও ভূমি মালিকদের পক্ষ থেকে সংশোধনের দাবি ওঠে। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলেও ডেভেলপাররা এই দাবি অব্যাহত রাখে। সর্বশেষ ২০ মে ঢাকা সিটি ল্যান্ড অনার্স অ্যাসোসিয়েশন রাজউক ভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে এবং দাবি পূরণ না হলে রাজউকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়। এরই প্রেক্ষিতে সরকার সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করে। এদিকে ঢাকা সিটি ল্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রধান সমন্বয়ক প্রফেসর ড. দেওয়ান এম. এ. সাজ্জাদ ড্যাপ সংশোধন সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের সভায় ঢাকার ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের অ্যাসোসিয়েশনকে পক্ষভুক্ত না করায় তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮-এর আলোকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০২৫ ঘোষণা অথবা ড্যাপ সংশোধন-পরিমার্জন না করা হলে তীব্র আন্দোলনসহ মামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।