
রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ঢাকার কাছের শিল্পনগরী গাজীপুরে গড়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীদের কমপক্ষে ৩০টি চক্র। চট্টগ্রামে ‘বড় ভাই’ পরিবর্তন করে সংগঠিত হচ্ছে এই অপরাধীরা। পর্যটন শহর কক্সবাজারে শতাধিক চক্রের বেশির ভাগ সদস্যই রোহিঙ্গা।
পুলিশ কোথাও এই অপরাধীদের তালিকা তৈরি করছে, কোথাও অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের ধরাও হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি আরো বাড়াতে হবে। বিভিন্ন জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সংক্রান্ত বৈঠকে এই অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে আড্ডা দেওয়া বন্ধ, অভিভাবকদের সচেতন ও কাউন্সেলিং করা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানোর মতামত এসেছে।
গাজীপুরে ৩০ চক্র : গাজীপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক শরীফ আহমেদ শামীম জানান, গাজীপুর জেলার স্থানে স্থানে কিশোর অপরাধীদের কমপক্ষে ৩০টি চক্র সক্রিয় রয়েছে। গাজীপুর সদর, পুবাইল, টঙ্গী, বাসন, গাছা, কোনাবাড়ী, কাশিমপুরসহ বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও রয়েছে কিশোর অপরাধীদের বিভিন্ন চক্র। এসব চক্র বিভিন্ন নামে এলাকায় পরিচিত। আধিপত্য বিস্তার, দখলবাজি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, মারামারি, এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটাচ্ছে তারা। তাদের কেউ নারীদের গলা থেকে সোনার চেইন ছিনিয়ে নেয়, কেউ তরুণীদের উত্ত্যক্তও করে।
ময়মনসিংহে পার্কে অপতৎপরতা : ময়মনসিংহ থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক নিয়ামুল কবীর সজল জানান, দিনের বেলা ও সন্ধ্যার পর ময়মনসিংহ মহানগরের পার্ক এলাকায় কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা চোখে পড়ে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক চক্রও আছে। কোচিংপাড়া খ্যাত বাউন্ডারি রোড, নাহা রোডেও তাদের দাপট দেখা যায়। মিথ্যা অভিযোগ তুলে কোচিং বা প্রাইভেট পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের তারা নাজেহাল করে। পার্ক এলাকায় এরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালায়। তাদের হাতে পার্কের কর্মচারীরাও নির্যাতনের শিকার হন। ময়মনসিংহ (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর মাহমুদ আলম বলেন, কিছুদিন আগে বিভাগীয় আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় কিশোরদের এই অপতৎপরতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে আড্ডা দেওয়া বন্ধ, অভিভাবকদের সচেতন ও কাউন্সেলিং করা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানোর মতামত এসেছে। ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার ওসি শিবিরুল ইসলাম বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে ‘বড় ভাই’ পরিবর্তন করেছে তারা : চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক কাজী মনজুরুল ইসলাম জানান, চট্টগ্রামজুড়ে কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা বেড়েছে। তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারধর, এমনকি খুনাখুনিতেও জড়াচ্ছে। অপরাধীরা আগের ‘বড় ভাই’ পরিবর্তন করেছে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) ২০১৯ সালে কিশোর অপরাধীদের তালিকা করেছিল। এখন তারা তালিকা হালনাগাদ করছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী, খুলশী, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, হালিশহর, ডবলমুরিং, কোতোয়ালি ও আকবর শাহ থানা এলাকায় কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা বেশি। এসব এলাকায় প্রতিটি কিশোর অপরাধী চক্রের সদস্য ১৫ থেকে ৩০ জন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করেন ‘বড় ভাই’ সাইফুল ইসলাম ও সবুজ। হালিশহরে তা নিয়ন্ত্রণ করেন মো. আসলাম। চান্দগাঁওয়ের নিয়ন্ত্রক শহিদুল ইসলাম এবং কোতোয়ালি এলাকার নিয়ন্ত্রক মো. আবিদ। এসব স্থানে আগের ‘বড় ভাই’ পরিবর্তন করা হয়েছে।
রাজশাহী মহানগরেও চলে অপতৎপরতা : রাজশাহী অফিস প্রধান সাদিকুল ইসলাম স্বপন জানান, আধিপত্য বিস্তার ও অন্যান্য অনৈতিক কাজে ব্যবহার করার জন্য সুবিধাভোগী শ্রেণির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রাজশাহী মহানগরে গড়ে উঠেছে কিশোর অপরাধী চক্র। এসব চক্রের সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডে আলাদা বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ আমলে। চক্রের সদস্যদের সরবরাহ করা হতো মাদক ও অস্ত্র। একসময় দলীয় পরিচয়ে মাঠ দাপালেও এখন তারা কৌশল বদল করে বিভিন্ন ব্যানারে করছে নানা অপরাধ। মহানগরের ভদ্রা মোড়, সিঅ্যান্ডবি, লক্ষ্মীপুর, টিকাপাড়া (খুলিপাড়া), কেদুর মোড়, হোসনিগঞ্জ বেতপট্টি, পাঠানপাড়া, কলাবাগান, অলোকার মোড়, নিউমার্কেট, তালাইমারি, বিমানবন্দর সড়ক, গ্রেটার রোড, সিটি বাইপাসসহ বিভিন্ন স্থানে চক্রের সদস্যরা সক্রিয় আছে।
সিলেটে কেউ টমটমচালক : সিলেট থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক ইয়াহইয়া ফজল জানান, সিলেট মহানগরে কিশোর অপরাধীরা আবারও তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা খুঁজছে নতুন আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা। যে কিশোররা আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবির সঙ্গে নিজেদের ছবি জুড়ে ব্যানার-ফেস্টুন লাগাত, তারাই এখন অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে নিজের ছবি টাঙিয়ে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছে। নগরের কুয়ারপাড়ে গেলে এমন ব্যানার-ফেস্টুন চোখে পড়ে। সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) সূত্র জানিয়েছে, নগরের ছয় থানা এলাকায় কিশোর অপরাধী রয়েছে। তাদের অপতৎপরতা থামাতে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। তালিকার বেশির ভাগেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। কেউ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে, কেউ টমটম চালায়। বেশির ভাগই বস্তির বাসিন্দা।
কক্সবাজারে সক্রিয় শতাধিক চক্র : কক্সবাজার থেকে বিশেষ প্রতিনিধি তোফায়েল আহমদ জানান, দেশের পর্যটন শহর কক্সবাজারে কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছেই। এখানে শতাধিক চক্রের বেশির ভাগ সদস্যই রোহিঙ্গা। শুধু শহরের কলাতলী গোলচত্বর (ডলফিন মোড়) স্টেশনেই অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরী অবস্থান করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে দলে দলে এসব কিশোর-কিশোরী এসে জড়িয়ে পড়ছে ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে। রাজধানী ঢাকা থেকেও কিশোর অপরাধীরা এই পর্যটন শহরে ভিড় করছে। কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি মো ইলিয়াস খান বলেন, ‘শহরে রোহিঙ্গা কিশোরদের তৎপরতা বেড়েছে। কয়েক দিন আগে কলাতলী গণপূর্ত পার্ক থেকে ১২ কিশোর অপরাধী আটক করি। তাদের ১০ জনই ছিল রোহিঙ্গা।’
কুমিল্লায় ২০ চক্র : কুমিল্লা প্রতিনিধি জাহিদ পাটোয়ারী জানান, কুমিল্লা মহানগরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীরা। এখানে আছে তাদের ২০টি চক্র। কয়েক দিন পর পর হঠাৎ প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে তাদের শক্তি ও উপস্থিতি জানান দেয় তারা। আধিপত্য ধরে রাখতে তারা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আট বছরে কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে এখানে।
খুলনার নতুন আপদ : খুলনা অফিস প্রধান এইচ এম আলাউদ্দিন জানান, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জনপদ খুলনায় নতুন আপদ কিশোর অপরাধ। খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) তালিকায় মহানগরের আটটি থানা এলাকায় কিশোর অপরাধী ২০৮ জন। নতুন আরো একটি তালিকা করেছে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরের টুটপাড়া, লবণচরা, নিরালা, ঘাট এলাকা, রূপসা, জোড়াগেট, সোনাডাঙ্গা, খালিশপুর ও দৌলতপুর এলাকায় কিশোর অপরাধীদের একাধিক গ্রুপ রয়েছে। নগরের বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজ এলাকায় এসব চক্র সক্রিয় আছে। কেএমপির পক্ষ থেকে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অবাঞ্ছিতদের প্রবেশ নিষেধ উল্লেখ করা হলেও তা মানছে না তারা।