Image description

ছয় বছরের শিশু জিহানের বাবা নাসিরুদ্দিন খান মিন্টু ও মা জহুরা খাতুন দুজনই কর্মজীবী। দিনের অনেকটা সময় মা-বাবার সান্নিধ্য পায় না শিশুটি। বাসায় দাদি ও কাজের মেয়ের সঙ্গে কাটে বেশির ভাগ সময়। জিহান যখন আরো ছোট, খাবার খেতে ঝামেলা করলে স্মার্টফোনে কার্টুন ছবি দেখতে দিয়ে খাওয়ানো হতো তাকে।

এভাবে একপর্যায়ে স্মার্টফোনে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে সে। এখন তার বিনোদনের একমাত্র সঙ্গী ওই স্মার্টফোন।

যার কথা বলা হলো, সে নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার আনন্দ মডেল স্কুলের নার্সারির ছাত্র ছয় বছর বয়সী নাফিজউদ্দিন খান জিহান।

শুধু এই জিহান নয়, এখনকার আরো অনেক শিশুর অবসর কাটে স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে।

এসব আধুনিক যন্ত্রের প্রযুক্তিগত অ্যাপে তারা কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে শিশুদের বড় একটি অংশ বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করার চেয়ে ঘরের ভেতর একঠায় বসে স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে নেট ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপে বিচরণ করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিশুর শরীর ও মনে। এই আসক্তি এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে।

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের করা এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের ৮১.২ শতাংশ শিশু-কিশোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন সময় কাটায়। এদের ৯০ শতাংশই মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। 

দীর্ঘ সময় ধরে স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ রাখায় তাদের দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক শারীরিক বিকাশ। সমবয়সী বা খেলার সাথিদের সঙ্গে পর্যাপ্ত মেলামেশার অভাবে স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ও সামাজিকীকরণও ব্যাহত হচ্ছে।

জিহানের মা জহুরা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি আর ওর বাবা ওকে তেমন সময় দিতে পারি না। আগে বাসায় ওকে খাওয়ানোর জন্য আমাদের হেল্পিং হ্যান্ড স্মার্টফোনে কার্টুন ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন ও এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে ফোন ছাড়া ওকে খাওয়ানো প্রায় অসম্ভব। ফোন না দিলে কান্নাকাটি করে, খেতে চায় না। বাইরে যেতে চায় না, সমবয়সী বা অন্য কারো সঙ্গে তেমন মেশে না।’

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জান্নাতুল মিম ও ইফতেখার আলম টুটুল দম্পত্তির ছেলে আবতাহি আবদুল্লাহ। দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র আবদুল্লাহ তিন বছর বয়স থেকে স্মার্টফোন আসক্ত। এ নিয়ে আক্ষেপ করে মা জান্নাতুল মিম কালের কণ্ঠকে বলেন, বাসায় আমরা তিনজন মানুষ। ওর বাবা অফিসে চলে গেলে আমরা দুজনই বাসায় থাকতাম। আমি ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকলে ও একা হয়ে যেত। খেলার কেউ না থাকায় আমি ওকে স্মার্টফোনে ইউটিউব দেখতে দিতাম। এটাই হয়েছে কাল। এখন সে স্মার্টফোন ছাড়া কিছু বোঝে না। আশপাশে খেলার মাঠ বা খেলার সাথি না থাকায় ফোনেই গেম খেলে সময় কাটায় ও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু-কিশোরদের এই আসক্তিটা মূলত বেড়েছে করোনা মহামারির পর। সে সময় শিশুদের পড়াশোনার মধ্যে একটা স্থবিরতা চলে আসে। স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা এক রকম গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। শিশুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে টিকটক, মোবাইল রিলসসহ পাবজির মতো অনলাইন গেমস। এ ছাড়া অনলাইন ক্লাস শুরু হওয়ায় তারা ধীরে ধীরে স্মার্টফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা একসময় আসক্তির পর্যায়ে যায়। এ ছাড়া নগরায়ণের কারণে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকার বিষয়টিকেও তাদের এ আসক্তির কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. শামীম হোসেন নোমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে শিশু-কিশোর সবাই ভয়াবহভাবে অনলাইনে আসক্ত। তবে এরচেয়েও আশঙ্কার বিষয় হলো, এই অনলাইন আসক্তি পরবর্তী সময়ে অনলাইন জুয়া, বেটিং, কিশোর গ্যাং, মাদকাসক্তির মতো খারাপ দিকেও শিশুদের নিয়ে যেতে পারে। অনলাইন আসক্তি শিশুদের দৃষ্টিশক্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং মানসিক শক্তির ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সামিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা যা দেখবে, তাই শিখবে। এ জন্য আমাদের অভিভাবকদের নিজেদের আচরণ দিয়ে শেখাতে হবে যে স্মার্টফোন একটি প্রয়োজনীয় জিনিস। এটি সময় কাটানো বা বিনোদনের জন্য নয়। একই সঙ্গে অভিভাবকদের শিশুদের জন্য বিনোদনের জন্য বিকল্প তৈরি করতে হবে, যা হবে শিশুর মেধা-মনন সুষ্ঠু বিকাশের সহায়ক। তাদের সময় দিতে হবে। তাদের একাকিত্ব অনুভব করতে দেওয়া যাবে না। তাদের ছোট থেকে অবশ্যই সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রবিউল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, আমাদের অভিভাবকরা যদি জানতেন স্মার্টফোন বা অনলাইন ডিভাইস পরোক্ষভাবে শিশুদের ঠিক কতটা ক্ষতি করে, তাহলে তাঁরা শিশুদের হাতে এসব দেওয়ার আগে দুবার ভাবতেন। এটা শিশুদের দৃষ্টিশক্তিকে তো দুর্বল করেই, একই সঙ্গে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এতে শিশুর মেধার সঠিক বিকাশ ঘটে না এবং তারা একগুঁয়ে ও জেদি হয়ে যায়।