Image description
পিআর পদ্ধতি ও জরিপ ইস্যুতে তোলপাড়

ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সাথে ঐকমত্য কমিশন ও এনসিপির নেতাদের সাক্ষাৎ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন, জোর করে পিআর পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়ে কমিশন ও এনসিপি আসন্ন নির্বাচনকে বানচাল করতে চায়। তবে কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ কমিশনের পক্ষ থেকে ছিল না। এটি ছিল ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ। কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর ড. আলী রীয়াজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এ বিষয়ে জাতীয় সংস্কার কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, রাষ্ট্রদূত আমাদের কাছে পিআর পদ্ধতি ও সংস্কার নিয়ে জানতে চেয়েছেন। দূতাবাস সূত্রও জানিয়েছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিজ থেকে কাউকে ডাকেননি। যারা এসেছিলেন তারা নিজ থেকে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায় ব্যক্ত করায় রাষ্ট্রদূত তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এর আগে এনসিপির নেতারা রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের বিষয়েও সূত্র একই তথ্য জানিয়েছে। সমালোচকদের মতে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও এনসিপি পিআর পদ্ধতির পক্ষে। আবার ঐকমত্য কমিশনের কমপক্ষে তিনজন সদস্য মার্কিন নাগরিক। তারা ব্যক্তিগত সাক্ষাতের সুযোগে পিআর পদ্ধতি চালুর বিষয়ে মার্কিন সরকারের সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও করতে পারেন।

এদিকে, সুজন ও ব্র্যাকের জরিপ নিয়েও সমালোচনার ঝড় বইছে। সুজনের জরিপে আসন্ন নির্বাচনে বেশির ভাগ মানুষ পিআর পদ্ধতি চায় বলে দাবি করা হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হলোÑ পিআর পদ্ধতি কী তা বেশির ভাগ মানুষ জানেই না। বিশেষজ্ঞরা এই দুই সংস্থার জরিপ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, জরিপ করতে হলে কতগুলো ধাপ অনুসরণ করতে হয়। সুজন বা ব্র্যাক সেগুলো অনুসরণ করেছে কিনাÑ তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করে তারা বলেছেন, বিভ্রান্তিকর এসব ‘টেবিল মেইড’ জরিপ মানুষ বিশ্বাস করেনি, করবেও না। কারণ পিআর পদ্ধতি কীÑ তা বেশির ভাগ মানুষ জানে না, বোঝেও না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই পদ্ধতি কতটা জরুরি তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তারা। এ সম্পর্কে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সুজনের জরিপ করেছে সারা দেশের এক হাজার ৩৭৩ জন। যার মধ্যে পুরুষ এক হাজার ৩৩ জন, নারী ৩৩৫ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের পাঁচজন। জরিপটি মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়। এতে মোট ৪০টি প্রশ্ন রাখা হয়, যার উত্তর দেন অংশগ্রহণকারীরা। জরিপ চলাকালে ১৫টি নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ তাদের মতামত জানান। জাতীয় সংসদ (নি¤œকক্ষ) ও সিনেট (উচ্চকক্ষ) নিয়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে মত দিয়েছেন জরিপে অংশ নেয়া ৬৯ শতাংশ মানুষ। আনুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনের পক্ষে ৭১ শতাংশ মানুষ।

ব্র্যাকের জরিপ নিয়ে একজন প্রশ্ন রেখে বলেন, ব্র্যাক আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগী সংস্থা। ইতোমধ্যে আওয়ামী দোসর সংবাদিক নবনীতা চৌধুরী ব্র্যাকের জরিপ নিয়ে প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের আমলে মানুষ নিরপেক্ষ ভোট চায় কি-না, হাসিনার সরকারকে মানুষ চায় কি-না তা নিয়ে তো কোনো জরিপ করেনি ব্র্যাক। নির্বাচনের সন্ধিক্ষণে হঠাৎ করে তাদের এই জরিপ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গত ১৫ বছরে তারা কোথায় ছিল?

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ডিগ্রিধারী একজন প্রফেসর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জরিপ দুই প্রকারÑ কোয়ান্টিটিভ ও কোয়ালিটিভ। কোয়ান্টিটিভ জরিপে নমুনা নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশে যদি সাড়ে ১২ কোটি ভোটার থাকে, সেখানে জরিপের জন্য কতজন নমুনা নেয়া হবে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে এক দেড় হাজার নমুনায় কখনোই সঠিক ফল আসবে না। তিনি বলেন, এখানে জেএনজি (নতুন ভোটার) থেকে শুরু করে যুবক, মধ্যবয়সী, এমনকি একেবারে বয়োবৃদ্ধ ভোটারও আছেন। তাদের মধ্যে আবার শিক্ষা, পেশা, বেকারত্বসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির ভোটার আছে। কোন পেশার ভোটারের কত সংখ্যক নমুনা নেয়া হয়েছে, জরিপ কী সরাসরি হয়েছে নাকি অনলাইনে হয়েছে, কারা জরিপ করেছে, কতদিন সময় নিয়ে এই জরিপ করা হয়েছেÑ এগুলোসহ অনেক ফ্যাক্টর আছে। তিনি বলেন, পিআর নিয়ে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থনের কথা সুজনের জরিপে তুলে ধরা হয়েছে তা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। অন্যদিকে, ব্র্যাকের জরিপে রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থনের যে তথ্য বা ভোট দিতে না চাওয়ার যে পরিসংখ্যান এসেছেÑ তাও পক্ষপাতমূলক মনে হয়েছে। ব্র্যাকের জরিপ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. আবুল মনসুর বলেন, এগুলো ফরমায়েশি জরিপ। এগুলো মানুষ বিশ্বাস করে না।

এদিকে, জামায়াতে ইসলামী নেতাদের ‘নির্বাচনে হতে হবে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর) পদ্ধতিতে’-এমন বক্তব্য নতুন করে আলোচনা তৈরি করেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রশ্ন উঠছে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন পদ্ধতিকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কই আগামী নির্বাচনকে সঙ্কটে ফেলে দেয় কি-না। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও এনসিপির নেতাদের সাক্ষাৎ করাকে অনেকেই নির্বাচনকে পেছানো বা ‘বানচাল’ করার ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছেন। এক দিন আগেও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। যদি হয় তবে আমাদের শহীদ ভাইদের লাশ সরকারকে ফেরত দিতে হবে। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়কের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, এনসিপি যেকোনো উপায়ে আসন্ন নির্বাচন বানচাল করতে চায়। নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারীর ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না’ এমন বক্তব্য স্বৈরাচারের পদধ্বনি বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, আজকে আমরা অনেক কথা শুনতে পাই, কেউ কেউ বলেন, হুমকি দেন যে, আগামী দিন (ফেব্রুয়ারি) নির্বাচন হতে দেবেন না। মনে হচ্ছে, সেই স্বৈরাচারের যে আচরণ ছিল, স্বৈরাচারের যে কথা ছিল সেই ধরনের কথার পদধ্বনি আমরা শুনতে পাই। আমি আহ্বান জানাব, আপনাদের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকেন, ধমক দিয়ে নির্বাচনী অভিযাত্রাকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতার ভাগাভাগিসহ রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য সরকার কিংবা অন্য কারো ওপর চাপ তৈরির জন্যই ‘পিআর পদ্ধতিতে’ নির্বাচনের দাবিটি সামনে আনা হয়ে থাকতে পারে। তবে তারা এও মনে করেন, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব না ঘুচলে সেটি আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সঙ্কটে ফেলে দেয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর তারানা বেগম ইনকিলাবকে বলেন, পিআর পদ্ধতি নতুন সিস্টেম। এ সম্পর্কে মানুষ সেভাবে অবগত নয়। জাতীয় সংস্কার কমিশন অনেকগুলো সংস্কারের কথা বলেছে। সবকিছু এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন করা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, এক সময় ইভিএম নিয়ে মানুষ কিছুই জানত না। পরে ধীরে ধীরে মানুষ জেনেছে। কিন্তু বিতর্কিত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ইভিএম বাতিল করতে হয়েছে। সরকার ও রাজনীতি বিভাগের এই প্রফেসর বলেন, আমরা যদি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক উৎসবমুখর একটি নির্বাচন করতে পারি। তাতেই একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসবে। তখন সরকার চাইলে সংসদে মতামত নিয়ে পিআর পদ্ধতি চালু করতে পারবে। ব্র্যাকের জরিপ নিয়ে তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয়নি এটা কোনো সায়েন্টিফিক জরিপ। আর সুজনের জরিপে ৭২ শতাংশ মানুষ পিআরের পক্ষে, এটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি বলেন, বিশ্বাস না হলে আপনি নিজেই আপনার আশপাশের ১০ জনকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারবেন তারা পিআরের পক্ষে তো দূরের কথা, এটি বোঝে কি-না। তিনি বলেন, এসব বিষয় সামনে আনা মানে অস্থিরতা সৃষ্টি করা, জটিলতা তৈরি করা। এতে করে সন্দেহ থেকেই যায়Ñ যারা এগুলো করছে তারা আসলে নির্বাচন পেছাতে বা বানচাল করার ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, তারা মনে করেন, নির্বাচনকে বিলম্বিত করার ‘ষড়যন্ত্র ও কৌশল’ হিসেবেই এসব ইস্যু সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। নির্বাচন সময়মতোই হবে। এ নিয়ে সঙ্কট হবে না। মানুষ ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করবে এবং সেই প্রতিনিধিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। সেই ভোটই মানুষ দেখতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদকতা বিভাগের প্রফেসর ড. আবুল মনসুর বলেন, পিআর পদ্ধতি যে দেশে ১৫ বছরে বেশি সময় ধরে ভোটেরই সিস্টেম নেই, গণতন্ত্র নেইÑ সেই দেশে এসব কখনোই কার্যকর করা যাবে না; বরং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সরকার এলে সেটিই হবে আমাদের সবার পরম পাওয়া। আমার মনে হয়, এদেশের মানুষ এর চেয়ে বেশি কিছু চায় না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, পিআর পদ্ধতিকে ঘিরে যে বিতর্ক হচ্ছে তার মূল্য উদ্দেশ্য রাজনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্ন। দলগুলো নিজের স্বার্থ অনুযায়ী অবস্থান নিয়েছে।