
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) এবং হল ও হোস্টেল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচনি উত্তাপে সরগরম ক্যাম্পাসটি। নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। অভিনব কৌশলে চেষ্টা করছেন তাদের মন জয় করতে। চাকসু নির্বাচন নিয়ে আলোচিত তিন সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন যুগান্তরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি। তারা হলেন-ছাত্রদলের সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়, সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোটের ইব্রাহিম হোসেন রনি ও স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের মাহফুজুর রহমান। তারা সবাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে পাশে থাকার কথা বলেছেন।
শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে আমরা আপসহীন-সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় : চাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলে ভিপি প্রার্থী হয়েছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়। ছাত্রদলের সক্রিয় ও আলোচিত এই নেতা ‘মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্রনেতা’ হিসাবে পরিচিত। ২০১৯ সালে তিনি ছাত্রলীগের হাতে নির্মম পাশবিকতার শিকার হন। মারধরের পর মারা গেছেন ভেবে তাকে ফেলে যায় তারা। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি সেরে উঠেন।
প্যানেল সাজানোর ক্ষেত্রে আপনারা কোন বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্রদলের প্যানেল ঘোষিত হয়েছে সবার মতামতের ভিত্তিতে। চাকসু নির্বাচনের জন্য ২ শতাধিক নেতাকর্মী আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। সেখান থেকে যারা অতীতে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন এবং বর্তমানে শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ করে যাচ্ছেন, দল তাদের বেছে নিয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, অতীত ও বর্তমান কর্মকাণ্ডের বিষয়গুলোকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে আপনারা কী করবেন-প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে আমরা সব সময় আপসহীন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এত বছর পরও শতভাগ আবাসন নিশ্চিত না হওয়া দুঃখজনক। তাই শতভাগ আবাসন নিশ্চিত করা, কিংবা আপাতত আবাসন ভাতা আদায় করতে আমরা কাজ করব। এছাড়া ডাবল রেললাইন চালু এবং শাটলে নিরাপত্তা নিশ্চিত, চবি মেডিকেল সেন্টারে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল সেবা নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধি ও প্রক্রিয়া সহজ করা, নারীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস বিনির্মাণ আমাদের লক্ষ্য।
শিক্ষার্থীরা কেন আপনাদের বেছে নেবে-প্রশ্নের জবাবে সাজ্জাদ বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। তাদের সব সংকটে পাশে ছিলাম। অতীতে ছাত্রদল কখনো চবিতে হল দখল, খুনের রাজনীতি করেনি। ৫ আগস্ট-পরবর্তী আমাদের স্বচ্ছ রাজনীতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। গুপ্ত হামলা বন্ধ, নারী হেনস্তার প্রতিবাদ, চারুকলা ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে ফেরানো-এমন সব যৌক্তিক আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলাম আমরা। তাই শিক্ষার্থীরা আমাদের ওপর আস্থা রাখবে, এটাই বিশ্বাস।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আপনারা কেমন আশাবাদী-জানতে চাইলে সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আমরা শতভাগ আশাবাদী। তবে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন নিয়ে অনেক অভিযোগ এসেছে। সেখানে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত হয়নি। তাই আমাদের এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা শঙ্কা কাজ করছে। দেখা যাক এখানে কতটুকু সুষ্ঠু নির্বাচন হয়।
যৌক্তিক সব দাবিতে সব সময় শিক্ষার্থীদের পাশে থাকব-ইব্রাহিম হোসেন রনি : চাকসু নির্বাচনে ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইব্রাহিম হোসেন রনি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামের অন্যতম আলোচিত সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। নাটোরের বাগাতিপাড়ার সন্তান ইব্রাহিম হোসেন রনি ইতিহাস বিভাগের এমফিলের শিক্ষার্থী। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য এবং চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
আপনাদের প্যানেলটি কেন অন্যদের থেকে আলাদা-প্রশ্নের জবাবে ইব্রাহিম হোসেন রনি বলেন, আমাদের প্যানেলটি অন্যদের চেয়ে আলাদা, কারণ আমরা শুধু আমাদের সাংগঠনিক লোক নিয়ে প্যানেল করিনি। যারা আমাদের সংগঠনের বাইরে থেকেও বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক কাজ, ক্লাব, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণমূলক কাজ করেছে; তাদেরও সঙ্গে নিয়েছি। আমাদের প্যানেলে একজন অন্ধ ও সনাতন ভাইকেও রেখেছি। এছাড়া নারী শিক্ষার্থী বোনদেরও আমরা প্যানেলে রেখেছি; যা আমাদের প্যানেলকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
শিক্ষার্থীরা কেন আপনাদের বেছে নেবে-প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর ছাত্রশিবির অসংখ্য কাজ করেছে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে। মাসব্যাপী ইফতার মাহফিল, খেলাধুলার আয়োজন, উচ্চশিক্ষা সেমিনার, নবীনবরণ, ক্যারিয়ার গাইডলাইন প্রোগ্রামসহ অনেক কাজ করেছি আমরা। এর বাইরে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, ঠান্ডা পানির ফিল্টার বসানোর কাজ আমরা হাতে নিয়েছি। যেগুলো আচরণবিধির কারণে বন্ধ আছে। নির্বাচনের পরপরই আমরা এই কাজগুলো শুরু করব। এছাড়া আমাদের প্যানেলে যারা আছে, সবাই ক্লিন ইমেজের। পাশাপাশি আবাসন, নিরাপদ ক্যাম্পাসসহ সব ইস্যুতে আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম। এজন্যই আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীরা আমাদের ওপর আস্থা রাখবে।
নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে আপনারা কী করবেন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নির্বাচিত হই বা না হই, তাদের যৌক্তিক সব দাবিতে সব সময় পাশে থাকব। নিরাপদ ক্যাম্পাস, শতভাগ আবাসন, স্বস্তিদায়ক যাতায়াতব্যবস্থা ও সেশনজট নিরসনে কাজ করব। যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, হলগুলো জরাজীর্ণ ও পুরোনো, এগুলো সংস্কারেও আমরা কাজ করব।
নির্বাচনে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন কি না-প্রশ্নের উত্তরে ইব্রাহিম হোসেন রনি বলেন, ডাকসু ও জাকসুতে বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। এগুলো থেকে নির্বাচন কমিশনকে শিক্ষা নিতে হবে। যে কোনো ধরনের বিতর্কিত ও পক্ষপাতমূলক বিষয় থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারলে তারা ভালো নির্বাচন উপহার দিতে পারবেন।
শিক্ষার্থীদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কাজ করব-মাহফুজুর রহমান : চাকসুতে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেল’ থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মাহফুজুর রহমান। তিনি ছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম লড়াকু যোদ্ধা। সমন্বয়ক হিসাবে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। দলীয়ভাবে প্যানেল ঘোষণা না করার সিদ্ধান্ত থাকায় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান নিজেই স্বতন্ত্র প্যানেল ঘোষণা করেন। যেখানে জিএস পদে লড়ছেন সংগঠনটির সদ্য বহিষ্কৃত সংগঠক আরএম রশীদুল হক (রশিদ দিনার)। এছাড়া বিভিন্ন অঙ্গনে আলো ছড়ানো বেশকিছু শিক্ষার্থী রয়েছেন এই প্যানেলে।
কোন দিকগুলো বিবেচনায় আপনারা প্যানেল সাজিয়েছেন-প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল দিয়েছি। এজিএসের মতো শীর্ষপদসহ অন্য পদগুলোয়ও নারীদের অংশগ্রহণ আমাদের প্যানেলকে আলাদা করেছে। আমরা যোগ্যতা, পরিচ্ছন্ন ইমেজ ও জুলাইয়ের অবদানকে বিবেচনায় নিয়েছি।
শিক্ষার্থীরা কেন আপনাদের বেছে নেবে-প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিগত দিনে আমরা সক্রিয়ভাবে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম। আমরা যেহেতু দল থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছি, তাই আমাদের তেমন পিছুটান নেই। মাদার পার্টির ছায়াতলে না থাকায় আমরা সবার জন্য কাজ করতে পারব। তাই আমরা আশা করছি, শিক্ষার্থীরা আমাদের বেছে নেবে।
অনেকেই আপনাদের বাগছাসের প্যানেল বলছেন, এটা নিয়ে আপনার মতামত কী-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে আমি এবং দিনার ছাড়া কেউই কখনো রাজনীতি করেনি। তারা কখনো বাগছাসের সঙ্গে ছিল না। আমরাও দল থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র প্যানেল দিয়েছি। আমাদের জিএস প্রার্থী কিছুদিন আগেই দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। তাই এটাকে বাগছাসের অথবা দলীয় কোনো প্যানেল বলার সুযোগ নেই।
চাকসু নির্বাচনে জয়ী হলে আপনি কী করবেন-জানতে চাইলে বলেন, আমরা নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এত বছর পরও আবাসন সমস্যা, পরিবহণ সংকট, একাডেমিক অব্যবস্থাপনা ও সেশনজট বিদ্যমান। এগুলো নিরসনে কাজ করব। সেই সঙ্গে কাজ করব সুস্থ ও গতিশীল ছাত্ররাজনীতি এবং নিরাপদ ও শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠায়।