Image description

পলিটিক্সে যেকোনো কাজে দুইটা কম্পাস দিয়ে হিসাব করতে হয়। একটা হচ্ছে মোরাল কম্পাস। আরেকটা হলো রিয়েলিটি কম্পাস। এই দুইটা দিয়ে এনছিপির জোটের বিষয়টা দেখানোর চেষ্টা করি৷ 

 

মোরাল কম্পাস: আগে ছিল আওয়ামী লীগ আর বিএনপি৷ এখন হচ্ছে বিএনপি আর জামায়াত। সবসময়ই বেশ কিছু মানুষ দ্বিদলীয় বৃত্ত ভাঙার কথা বলতেন। তার জন্য দরকার শক্তিশালী একটা তৃতীয় দল। সেটা কখনোই উপস্থিত ছিল না। জাতীয় পার্টি ইন্ডিয়ান স্বার্থরক্ষা করার পর স্রেফ সার্কাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এখন এনছিপিকে মানুষ সেই তৃতীয় দল হিসেবে মনে করছে। জামাতের সাথে জোট করলে সেই অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

 

এনছিপি থেকে যারা এমপি ইলেকশন করতেসে তাদের মধ্যে অনেকে জামাতের সাথে জোট করাকে একদমই নিতে পারছে না। তাসনুভা জাবিন, সামান্তা শারমিন, নিভা আপু, নুসরাত তাবাসসুম প্রমুখ তো একপ্রকার হুমকির উপর রাখসে এনছিপির কোর লিডারদের। তারা চলে গেলে এনছিপির ক্ষতি হবে। তাদের একটা ফ্যান-ফলোয়িং আছে, ক্ষুদ্র হলেও। এনছিপি করার কারণে ফ্যান হয়েছে এরকমও আছে, আবার ইনডিভিজুয়ালের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এমনও আছে। মানে জোট করলে ক্ষতি যে কিছুমাত্রায় হবে তা নিশ্চিত৷ 

 

এনছিপির আজকের উত্থানের পিছনে বহু মানুষের সময়, শ্রম, মেধা আছে৷ তারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো কাজ করে গেছে। তাদের ব্যক্তিগত জীবন, অ্যাকাডেমিক লাইফ বাদ দিয়ে এনছিপির পক্ষে জনমত গঠনের কাজ করেছে৷ তারা চাচ্ছে না এই জোট৷ এবং তাদের মত উপেক্ষা করে যদি জোট হয় তাহলে এনছিপিকে তারা কখনো ক্ষমা করবে না।

 

রিয়েলিটি কম্পাস: হাসিনার আমলে তিনটা ইলেকশন কার্যত হয়-ই নাই। বিরোধীরা রাজপথে থেকেছে৷ তারপর দেড় বছর কার্যত কোনো সরকারের অস্তিত্ব নাই৷ একটা কলাগাছের ঝাড় আছে ক্ষমতায়। এরপর আমরা পার্লামেন্টারি পলিটিক্সের যুগে প্রবেশ করতে চলেছি। এটা একটা সম্পূর্ণ নতুন দুনিয়া, অন্তত তরুণদের দল এনছিপির জন্য৷ এখানে আপনার আওয়াজ শোনানোর জন্য আপনাকে সংসদে যেতেই হবে। রাস্তায় কাইন্দা গড়াগড়ি খাইলেও কাজ হবে না। 

 

বিএনপি কোনোক্রমেই ১০টার বেশি সিট ছাড়তে চাইবে না; তার ছাড়ার দরকার নাই। ৪ থেকে ৭টা সিটের কথা শোনা যাচ্ছিল। প্রথম কথা, এই সংখ্যক সিট যদি বিএনপি ছাড়েও সেখান থেকে এনছিপি জিতে আসবে এই গ্যারান্টি বিএনপি তাকে দেবে না। দ্বিতীয় কথা, গ্যারান্টি দিলেও সেই কাজ বিএনপি করবে এটা চোখ বুজে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নাই। ইটস পলিটিক্স, এনিথিং ক্যান হ্যাপেন। তৃতীয় কথা, ওই সকল আসনে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীরা দাঁড়িয়ে যেতে পারেন। তখন জেতা আরও কঠিন হয়ে যাবে৷ চতুর্থ কথা, সেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের হারাতে হলে দরকার পড়বে ধানের শীষ প্রতীকের। এখন এনছিপির টপ টেনের লোকও যদি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে, তাহলে তো এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিসে পড়ে যাবে এনছিপি। পঞ্চম কথা, ৪-৭টা সিট নিয়ে লাভটা কী আসলে? এই কয়জনের আওয়াজ সংসদে অরণ্যে রোদনের মতো শোনাতে পারে, যদি তারা বিএনপির সাথে জোট/সমঝোতা করে সংসদে যায়। 

 

জামাতের ভোট বেশিরভাগ মার্কা দেখে দেবে মানুষ, জামাতের খুব বেশি সংখ্যায় জনপ্রিয় নেতা নাই। সেই তুলনায় এনছিপিতে কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি। জামাত ২৫-৩০টা সিট আরামসে ছেড়ে দিতে পারে এনছিপিকে৷ এনছিপির নিজস্ব ভোটের পাশাপাশি জামাত যদি তাদের রিজার্ভ ভোটব্যাংক-কে নির্দেশনা দেয়, তাহলে ছাড়কৃত আসনগুলোতে এনছিপি ভালো পরিমাণ ভোট পেতে পারে৷

 

জামাত চ্যারিটি সংগঠন হিসেবে খুবই ভালো৷ কিন্তু তাদের পলিটিক্যাল জ্ঞান-অভিজ্ঞতা কম৷ তাই, এনছিপি জামাতে বিলীন তো হবেই না, বরং, এই জোটের ড্রাইভিং সিটেও চেপে বসতে পারে৷ বিপরীতে, বিএনপির সাথে জোট করলে এনছিপির বিলীন হয়ে যাবার সম্ভাবনা অধিক। বিএনপির নেমিনেশন-বঞ্চিত নেতারাও জিতে আসার ক্ষমতা রাখে বিভিন্ন আসনে। মানে, নেতার অভাব নেই৷ এনছিপি যদি বিএনপির সাথে যায়, তাহলে বেইল কম পাবে। শুধু সিট কম দেবে তাই না, সবদিক থেকেই। 

 

হাসিনা পতনের পর থেকে বিএনপি অনেক ফাকাপ করসে, তাই ২৮০টা সিটের জায়গায় এখন টার্গেট ২০০টা সিট৷ তবে এখন পর্যন্ত ভাব যা বোঝা যাচ্ছে, বিএনপিই পরবর্তী সরকার গঠন করতে চলেছে৷ এদিকে ইন্ডিয়ান এস্টাবলিশমেন্ট বিএনপিকে তেল দিয়ে গাছের আগায় তুলে ফ্যাসিস্ট বানাবার জন্য রেডি৷ এখানে দুটো ব্যাপার কাজ করবে। 

 

এক. যদি এনছিপি জোট বা সমঝোতায় যায় বিএনপির সাথে, তাহলে তার গায়ে কাদা লাগবে। সেই কাদা অবশ্য জামাতের সাথে গেলেও লাগবে৷ কিন্তু মানুষ যা চোখে দেখে তার মূল্য অনেক বেশি দেয়। যেমন এই জেনারেশনকে আপনি কোনোভাবেই জুলাইকে ভুলাইতে পারবে না। তেমন মানুষ যদি চোখের সামনে বিএনপিকে ফ্যাসিস্ট হতে দ্যাখে, সেই বেদনা সে ভুলবে না। বিএনপির সাথে এনছিপিকেও ঘাউড়াবে জনগণ৷ যেমন আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টিকে ঘাউড়ায়। 

 

দুই. বিএনপি যাতে ফ্যাসিস্ট না হয়ে উঠতে পারে অথবা অনেক সিট পেয়ে যাচ্ছেতাই আচরণ করতে না পারে তার জন্য দরকার পাওয়ারফুল বিরোধী দল। সেই ক্যালকুলেশনে শুধু জামাত না, আপ-বাংলাদেশ সহ আরও অপরাপর জুলাইয়ের পক্ষের শক্তির সাথে জোট করা দরকার। সম্মিলিত শক্তি যদি চেকে রাখে, তাহলেই একমাত্র বিএনপিকে লাইনে রাখা যাবে। নাহলে তা বিএনপির নিজের জন্য যেমন ক্ষতি, দেশের জন্যও৷

 

অনেকে বলছেন, জামাতের সাথে জোট করলে এনছিপির মধ্যপন্থী রাজনীতি কম্প্রোমাইজড হয়ে যাবে এবং অতি ডানের দিকে ঝুঁকে যাবে৷ জামাত নিজেই এখন আর বাংলাদেশে ফার-রাইট পার্টি না। তারা নিজেরা যেমন আগের অবস্থান থেকে তুলনামূলক বামে চেপে এসেছে, তেমন হেফাজত সহ আরও অনেক ছোটো ছোটো দল নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সহ আরও নানান অ্যাস্পেক্টে ফার-রাইট পজিশন নিয়েছে৷ বরং, জোটে গেলে জামাতকে মধ্যপন্থী দলে পরিণত করতে পারে এনছিপি। তবে এনছিপি নিজে মধ্যপন্থী দল কিনা, বা হতে চায় কিনা সেটি একটি বড়ো প্রশ্ন। তার উত্তর এই পোস্টে না দিই৷ 

 

সবচেয়ে বড়ো অথচ ফালতু ডিবেটটা হচ্ছে, জামাতের সাথে একবার জোট করলে তারপর আর জামাত-ট্যাগ মুক্ত হওয়া সম্ভব কিনা। এই জিনিসের বিস্তারিত ব্যাখ্যার দরকার নেই। শুধু বিএনপির দিকে তাকাতে বলব, উত্তরটা পেয়ে যাবেন। 

 

যেকোনো পলিটিক্যাল ডিসিশন নেবার আগে দুটো কম্পাস থেকেই ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। যেদিকে পাল্লাটা ভারী থাকে, সেদিকে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ৷ তবে, নেগোসিয়েশনে এত বেশি সময়ক্ষেপণের দরকার নেই/ছিল না৷ তার চেয়ে যদি শহিদ হাদি হোত্তার বিচার চেয়ে ইনকিলাব মঞ্চের হাতকে শক্তিশালী করতেন এবং সরকারকে নানাদিক থেকে চাপ প্রয়োগ করে অন্তত অপরাধীদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করতেন, দেশের মানুষ আপনাদের গ্রহণ করতো, তা আপনি যার সাথেই জোট করেন না কেন৷ অনেক মানুষের লেখা দেখছি এরকম— তারা শুধু চান ভাই হোত্তার বিচার৷ এরপরে তারা আর কোনো কথাই বলতে চান না। অবশ্যই এটি আবেগের কথা। তবে এই আবেগকে আপনাদের বুঝতে হবে৷ 

 

কনক্লুশান: বিএনপির সাথে জোট করার চেয়ে জামাতের সাথে জোট করা ভালো। সবচেয়ে ভালো একা মুভ করা৷ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার হাদি হোত্তার বিচার নিশ্চিত করা৷ বাকি ডিসিশন আপনাদের।