Image description

বাংলাদেশের রাজনীতি যেন হয়ে উঠেছিল হিংসা-বিদ্বেষ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু মনে করা হতো। গালাগালি, প্রতিপক্ষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, কাদা-ছোড়াছুড়ি, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ করা হতো ফ্রি-স্টাইলে। একদল অন্য দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দালালি এবং বিদেশিদের এজেন্ট অভিহিত করা নিত্য ঘটনা। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজনৈতিক অঙ্গনের পুরোনা ঘৃণা-বিদ্বেষের কদাকার চিত্রের অবসান করতে চান। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন ধারার রাজনীতি চর্চার বার্তা দিয়েছেন। তিনি সব দলের নেতাদের নিজ নিজ আদর্শে থেকেও দেশের প্রয়োজনে গঠনমূলক বক্তব্য দেয়ার পাশাপাশি সংযম, সহনশীলতার আহ্বান জানিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবারের গণসংবর্ধনায় তারেক রহমানের এই বক্তব্য এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান সর্বত্রই প্রশংসিত হচ্ছে; রাজনৈতিক অঙ্গনেও সাড়া ফেলেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও প্রতিশোধের ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে আসার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত। প্রতিহিংসার রাজনীতির জমিনে প্রত্যাশিত আক্রমণাত্মক বক্তব্যের পরিবর্তে সংযম, সহনশীলতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির কথা তুলে ধরে তারেক রহমান নতুন রাজনীতির সূচনা করেছেন বলে মনে করছেন। তারা বলেন, তারেক রহমানের বক্তব্যে পেশিশক্তির আস্ফালন কিংবা প্রতিপক্ষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো প্রয়াস ছিল না। নেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের সস্তা রাজনীতি। ধ্বংসাত্মক ভাষার পরিবর্তে গঠনমূলক ও ইতিবাচক রাজনীতির যে বীজ তিনি বপন করেছেন, তা সমকালীন রাজনীতিতে এক বিরল দৃষ্টান্ত। বিশ্লেষকদের মতে, তার এই সংযত ভঙ্গি এবং দূরদর্শী কথাগুলো দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে, যা সর্বমহলে দারুণভাবে সমাদৃত হচ্ছে।

দীর্ঘদিনের নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে জনসমুদ্রের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাকে বরণ করা, স্বাগত জানানো এবং এক পলক দেখার জন্য যেমন লাখো মানুষের জোয়ার ঠেকেছিল রাজধানীর ৩০০ ফিটে, একইভাবে দেশে ফিরে তিনি দেশের মানুষের উদ্দেশে কী বলেন, কী ভাষা ব্যবহার করেনÑ এসব নিয়ে সবারই প্রবল আগ্রহ ছিল। কারণ স্বাধীনতার পরপরই দেশের রাজনীতিতে ঘৃণা-বিদ্বেষ, প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার রাজনীতি বপন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং তা পরবর্তী সময় দীর্ঘদিন ধরে লালন করে চলেছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। যিনি ক্ষমতাসীন থাকাকালে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি ক্ষোভ, প্রতিহিংসা, বিদ্বেষের কারণে হেন কোনো গালাগাল বা অশ্রাব্য ভাষা নেই; যা ব্যবহার করেননি। যদিও হাল আমলে নিজেদের বড় রাজনৈতিক দল মনে করা আরো একটি রাজনৈতিক দলও সুযোগ পেলে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াতে ছাপিয়ে যায় আওয়ামী লীগকেও। এ রকম পরিস্থিতি থেকে আওয়ামী দুঃশাসনের দেড় দশকে ভাইকে হারিয়েছেন, নিজে পরিবার নিয়ে কাটিয়েছেন নির্বাসিত জীবন, মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মাকে দেখেছেন কারাবন্দি হতে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি ও পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও সেই দুঃশাসনে নিজ দলের অনেক নেতাকর্মী হামলা-মামলায় জর্জরিত, গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। যার নিজের, দলের এবং পরিবারের ওপর এমন জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়নের স্ট্রিম রোলার চলেছে, আওয়ামী লীগের পতনের পর স্বাভাবিকভাবে সবাই মনে করেছিলেনÑ তিনি অন্যায়-অত্যাচারের বদলা নেবেন। কিন্তু ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেয়া ভাষণে বারবার তিনি প্রতিহিংসা পরিহারের নির্দেশনা দিয়েছেন।

এমনকি গত বৃহস্পতিবার দেশে ফেরার পর গণঅভ্যর্থনায় যে বক্তব্য দিয়েছেন সেখানে তিনি ঘৃণা-বিদ্বেষ, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতির পরিবর্তে সংযম, ধৈর্য, আইনের শাসন, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তা, গণতন্ত্র পুনর্গঠনের রাজনীতির বার্তা দিয়েছেন। তার এই বক্তব্যের পর থেকেই সর্বমহলে প্রশংসায় ভাসছেন তারেক রহমান।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিনে সংযত ও পরিমিত ভাষা ব্যবহার করে তারেক রহমান একটি ভিন্ন রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে মামলা ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হওয়ার পরও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে সরে আসার ঘোষণা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন রাজনীতির সূচনাই মনে করছেন তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, তার বক্তব্যে অতীতের রাজনৈতিক সংঘাত বা ব্যক্তিগত নির্যাতনের প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়নি। পরিবর্তে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তা, গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থার কথা তুলে ধরা হয়। তার ওই বক্তব্য রাজনীতিতে কৌশলগত রূপান্তরের স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। ভাষা, টোন, বিষয়বস্তু ও লক্ষ্যÑ সব মিলিয়ে এই বক্তব্যে একটি সচেতন ও পরিকল্পিত পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য কিংবা প্রতিশোধমূলক রাজনৈতিক ভাষা এড়িয়ে তিনি এমন সব কথা বেছে নিয়েছেন, যা রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগী ও ভবিষ্যতমুখী। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তারেক রহমান শুধু দলীয় নেতা হিসেবে নয়, নিজেকে জাতীয় নেতৃত্বের ভূমিকায় প্রস্তুত করছেন। ‘বাংলাদেশ বিনির্মাণ’-এর পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে তিনি শুধু ভবিষ্যৎ নয়, দেশের গত ৫৪ বছরের রাজনৈতিক ও সামাজিক চড়াই-উৎরাইয়ের একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাও তুলে ধরেন। তিনি তার ভাষণে তরুণ নেতৃত্ব ও তরুণ প্রজন্মের প্রতি বারবার গুরুত্ব আরোপ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের একটি রূপরেখা তুলে ধরেন। এটি কেবল রাজনৈতিক আশ্বাস নয়; বরং একটি প্রজন্মগত রূপান্তরের ডাক।

সব মিলিয়ে, তারেক রহমানের এই ভাষণ বিএনপির রাজনীতিতে কেবল বক্তব্যের পরিবর্তন নয়; এটি কৌশল, দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য নির্ধারণের পরিবর্তনের ইঙ্গিত। সংঘাত থেকে ঐক্য, প্রতিশোধ থেকে পুনর্গঠন, দলীয় রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রচিন্তা তারেক রহমানের বক্তব্যের মূল বার্তা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারি বলেন, তারেক রহমানের কথাবার্তা, বক্তব্য, শব্দ চয়ন, আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তিনি এখন অনেক বেশি পরিপক্ব একজন রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছেন। গণঅভ্যর্থনায় তিনি যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়েছেন সেখানে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন, সমস্যা উত্থাপন করেছেন, সমাধানের পরিকল্পনা জানিয়েছেন। এটা রাজনীতির সুবাতাস বইয়ে আনবে। এছাড়া বড় জনসমাবেশে, লাখো মানুষের সামনে যে ধরনের সংযত, ভারসাম্যপূর্ণ ও দৃষ্টিভঙ্গিমূলক ভাষা প্রয়োজন তারেক রহমান সেই বাস্তবতাই মেনে নিয়েছেন। উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য কিংবা প্রতিশোধমূলক রাজনৈতিক ভাষা এড়িয়ে তিনি এমন এক টোন বেছে নিয়েছেন, যা রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগী ও ভবিষ্যতমুখী।

দেশের বিখ্যাত এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন তারেক রহমানের এখন যে রাজনৈতিক পরিপক্বতা দেখা যাচ্ছে সেই পরিপক্বতা ও জ্ঞান দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক প্রফেসর ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘তারেক রহমান দীর্ঘদিন পরে দেশে ফিরে এসেছেন। এই ১৭ বছরে তার মধ্য আমরা অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। পরিপক্বতা লক্ষ্য করেছি। আত্মসমালোচনার জায়গাও তিনি খোলা রেখেছেন। দীর্ঘদিন তিনি লন্ডন থেকে দলটা চালিয়েছেন, এখন তিনি মাঠে আসায় তার দল আরো শক্তিশালী হবে। তারেক রহমানের বক্তব্য ইতিবাচক। তিনি সবাইকে নিয়ে চলতে চান। তিনি তরুণদের কথা বলেছেন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যদি তার দল ক্ষমতায় যায়, তখন তিনি আজকের এই কথাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন কি-না, সেটিই হলো বিবেচ্য বিষয়। তবে তিনি যদি চাটুকারিতা, তেলবাজি পরিহার করে নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তিনি সফলতার দিকে এগিয়ে যাবেন।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘দীর্ঘ ১৭ বছর পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে এসেছে। এই প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে সংবর্ধনা জানিয়েছেন এবং আনন্দ উচ্ছ্বাসে অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব কম নেতার পক্ষেই এমন স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন ও গণঅভ্যর্থনা পাওয়া সম্ভব হয়েছে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, তারেক রহমান তার বক্তব্যের মাধ্যমে অতীত নয়, ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। সামনে এগোনোর বার্তা দিয়েছেন।