পতিত আওয়ামী লীগ সরকার যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাদের দমনের জন্য, সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই জুলাই গণহত্যার একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার রাজনৈতিক জীবনে এমন করুণ পরিণতি হবে তিনি সাড়ে ১৫ বছরের টানা শাসনামলে একদিনের জন্যও ভাবেননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস-জুলাই গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসাবে শেখ হাসিনাকে তার গড়া ট্রাইব্যুনালেই বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। যা ছিল দেশের ইতিহাসে ২০২৫ সালের সবচেয়ে বড় ঘটনা। মানুষ জানতে পেরেছে, কেউ ক্ষমতা পেয়ে স্বৈরাচার হয়ে উঠলে এর পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে। ভবিষ্যতে শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্ট যেন আর তৈরি না হয়, এ বিচার নজির হয়ে থাকবে বলে উল্লেখ করেন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। শেখ হাসিনা জুলাই গণ-আন্দোলনে ৫ আগস্ট পালিয়ে ভারত আশ্রয় নিলেও তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকরের দাবি দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের।
বছরজুড়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারে ছিল সক্রিয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। জুলাই আন্দোলনে সামনের সারির নেতা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ ৫৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলার বিচার শুনানিকালে। মানুষের দৃষ্টি ছিল শেখ হাসিনার বিচার কী হয় সেদিকে। রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত একটি দুঃসাধ্য কাজ করেই ফেলল। এক মামলায় শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া একই ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার একটি মামলায় ৬ মাসের কারাদণ্ড হয় হাসিনার।
প্রসিকিউশন জানায়, জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ড এবং সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৫টি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে দুটি ট্রাইব্যুনালে। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শকসহ মোট ১১৭ জনকে আসামি করা হয়। অভিযোগ দাখিল করা ১৫টি মামলার মধ্যে একটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে দেওয়া রায়ে হাসিনার বিচার হয়। চানখাঁরপুলে ৬ জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা মামলায় সাক্ষ গ্রহণ শেষে রায়ের জন্য রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল। ২০ জানুয়ারি এ রায়। ৩টি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। বাকি ১০টি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে।
রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ এক মামলা : গণ-অভ্যুত্থানের সময় গত বছরের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। এ মামলায় ১৯তম সাক্ষী হিসাবে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এ মামলায় ২০ জানুয়ারি রায় দেওয়া হবে। এ মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আসামি আট পুলিশ সদস্য।
তিন মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে : আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা যে তিনটি মামলায় এখন সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে, তার একটি গণ-অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানোর ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা। অপরটি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা। এছাড়া, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা একটি মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আবেদন করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়েছে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে। এ মামলার আরেক আসামি সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক।
তিন মামলায় আসামি ২৫ সেনা কর্মকর্তা : আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের ঘটনায় দুটি এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা একটি মামলায় ৮ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। সেদিনই মামলা তিনটি আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এই তিন মামলায় মোট আসামি ৩২ জন। এর মধ্যে ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে ১৫ জন এখন সেনা হেফাজতে আছেন। তাদের মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর্যায়ে আছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫ মামলা : মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ৫টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৭ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। এর আগে জুলাইয়ে আদালত অবমাননার একটি মামলায় শেখ হাসিনাকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-১। এদিকে ২০১৩ সালের মে মাসে মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি করা হয়েছে ২১ জনকে। এছাড়া আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকালে গুমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা দুটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ২৮ জন। আসামিদের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান ২৩ জন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন।
আইনের সংশোধন : গণ-অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে চার দফা সংশোধন আনা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ সংশোধনীর গেজেট প্রকাশ করা হয় ৬ অক্টোবর। সেই গেজেটে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলে তিনি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন। এছাড়া কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সদস্য, কমিশনার, চেয়ারম্যান, মেয়র বা প্রশাসক হিসাবে নির্বাচিত হতে পারবেন না বা এসব পদে নিয়োগ পাবেন না। এমনকি প্রজাতন্ত্রের (সরকারের) কোনো সেবায় নিয়োগ পাওয়ার অযোগ্য হবেন। সরকারের কোনো অফিসে (পাবলিক অফিস) থাকতে পারবেন না। তবে ট্রাইব্যুনাল কাউকে অব্যাহতি বা খালাস দিলে তার ক্ষেত্রে এসব বিষয় প্রযোজ্য হবে না বলেও আইনের সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে, তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। একই সঙ্গে তারা সরকারি চাকরিতে আর থাকতে পারবেন না।
ট্রাইব্যুনালে যত অভিযোগ : মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে ট্রাইব্যুনাল ১ ও ২-এ। বিচারের অগ্রগতি সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয় থেকে সর্বশেষ আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সাংবাদিকদের কাছে লিখিতভাবে তথ্য দেওয়া হয়। সে সময় বলা হয়, ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট অভিযোগ এসেছে ৪৫০টি। এসব তথ্য প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের পর ‘মিস কেস’ বা বিবিধ মামলা হয়েছে ৩০টি। এখানে উল্লেখ্য, মিস কেস তখনই মামলায় রূপ নেয়, যখন তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর চিফ প্রসিকিউটর ‘ফরমাল চার্জ’ দাখিল করেন ট্রাইব্যুনালে।
রাজউকের প্লট দুর্নীতির তিন মামলায় হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ড : ঢাকার পূর্বাচলের নতুন শহর প্রকল্পে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির পৃথক তিন মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ বছর করে মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড হয়। ঢাকার পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আবদুল্লাহ আল-মামুন ২৭ নভেম্বর এই রায় ঘোষণা করেন। পৃথক তিন মামলায় আসামির সংখ্যা ৪৭। তবে ব্যক্তি হিসাবে এই সংখ্যা ২৩। একটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ১২ জন। আরেকটি মামলায় শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়সহ আসামি ১৭ জন। অপর মামলায় শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ আসামি ১৮ জন। প্লট বরাদ্দের দুর্নীতির অভিযোগে গত জানুয়ারিতে পৃথক ৬টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই মামলাগুলোয় শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকসহ অন্যদের আসামি করা হয়। এই ছয় মামলার মধ্যে তিনটির রায় হয়।