Image description
চট্টগ্রামে দলীয় প্রার্থীর সমান্তরালে বিএনপি হ নেতাদের মনোনয়ন সংগ্রহের হিড়িক

চট্টগ্রামে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর সমান্তরালে বিএনপি নেতাদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের হিড়িক পড়েছে। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনে দলীয় মনোনয়ন পাননি এমন অর্ধশতাধিক বিএনপি নেতা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেছেন। দলের প্রার্থীর বাইরে কোনো কোনো আসনে সর্বোচ্চ আট জন পর্যন্ত বিএনপির নেতা মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।

এতে ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তবে দলীয় নেতাদের দাবি, আলোচনায় থাকতে এবং দলের হাই কমান্ডের নজরে আসতেই মনোনয়নপত্র নিচ্ছেন অনেকে। অনেকেই শেষ পর্যন্ত তা জমা দেবেন না, আর জমা দিলেও শেষ সময়ে এসে প্রত্যাহার করে নেবেন।
অন্যদিকে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতাদের দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহসহ সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীপ্রার্থী হলে কঠোর অ্যাকশানে যাওয়ারও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে বলেও দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় নিয়ে মোট ১৬টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এর মধ্যে নগরীতে চারটি, উত্তর চট্টগ্রামে সাতটি এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামে আসন সংখ্যা পাঁচটি। ১১ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণার পর তিনজন রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হয়। প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের শেষ সময় ২৯ ডিসেম্বর। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কার্যালয় থেকে ১৫৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এ পর্যন্ত নেয়া মনোনয়ন ফরমের তালিকায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামের ১৬ সংসদীয় আসনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণ অধিকার পরিষদ, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জেএসডি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি, জনতার দল, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ডেভেপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্র্টিসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।
চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিন জন। নগরীর পাঁচটি (চট্টগ্রাম-৪, ৫, ৮, ৯ ও ১০) আসনের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন বিভাগীয় কমিশনার ড. মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীন। জেলার ১০টি (চট্টগ্রাম-১, ২, ৩, ৬, ৭, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ ও ১৬) আসনের রিটার্নিং অফিসার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা। চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের রিটার্নিং অফিসার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন চৌধুরী।

চট্টগ্রামে ১৬টি আসনের মধ্যে বিএনপি এখন পর্যন্ত ১৪টিতে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। গত নভেম্বরের শুরুতে প্রার্থী ঘোষণার পর অন্তত সাতটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন, মশাল মিছিল ও সড়ক অবরোধের মতো ঘটনা ঘটে। এরপরও মনোনয়ন না পাওয়া নেতারা হাল ছাড়েননি; তারা মনোনয়নপত্র সংগ্রহসহ নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের অফিস থেকে দেওয়া তথ্যে দেখা যায় দলের নামে কিংবা স্বতন্ত্র হিসেবে বিএনপির মোট ৫৬ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া বিএনপির প্রার্থী আছেন ১৩ জন।

প্রায় সবকটি আসনেই বিএনপির একাধিক নেতা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। নগরীর প্রাণ কেন্দ্রের আসন চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাবেক আহ্বায়ক ও নগর কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ান। তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এর পাশাপাশি নগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এনায়েত বাজারের বাসিন্দা আবুল হাশেম বক্কর মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। একই আসনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন বিএনপি নেতা শামসুল আলম, তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। এ ছাড়া মনোনয়ন নিয়েছেন বিএনপি নেতা শাহজাদা মোহাম্মদ আহসান উল্লা খান ও বিপ্লব দে।

চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিন। কিন্তু এ আসনে মনোনয়নপত্র নেন আরেক নেতা নুরুল আমিন। তিনিও উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। এ ছাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা এ জেড এ খানের ছেলে জিয়াদ আমিন খান মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।

চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশাকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। এর বাইরে ফরম নিয়েছেন উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন, যুক্তরাষ্ট্র শাখা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল পাশা, ছাত্রদলের সাবেক সহ সম্পাদক রফী উদ্দিন ফয়সাল এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. তরিকুল আলম। চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। ওই আসনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা গোলাম আকবর খোন্দকার ও বিগত ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জসীম উদ্দিন শিকদার।

চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ এনামুল হক এনাম দলের প্রার্থী। এর বাইরে ফরম নিয়েছেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহজাহান জুয়েল, নগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি গাজী মোহাম্মদ সিরাজ উল্লাহ এবং বিএনপি নেতা সৈয়দ সাদাত আহমেদ।

চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে দলের প্রার্থী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার আলমগীর। ওই আসনে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আজিম উল্লাহ বাহার এবং বিএনপি নেতা ছালাহ উদ্দিন ফরম নিয়েছেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকু-) আসনে উত্তর জেলার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মো. সালাউদ্দিনকে দলীয় মনোনয়ন দেয় বিএনপি। তবে ওই আসন থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।

চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম। এর বাইরে এ আসনে ফরম নিয়েছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস ও সদস্য সচিব হেলাল উদ্দিন। চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে বিএনপির প্রার্থী দক্ষিণ জেলার সদস্য নাজমুল মোস্তফা আমিন। একই আসন থেকে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেন ও মজিবুর রহমানও মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।

চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) ও চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া আংশিক) আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-১৪ আসনটি এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অব. অলি আহমদ বীরবিক্রমকে ছেড়ে দিতে পারে বিএনপি। তবে সেই আসনেও বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেযোগ্য হলেন- সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের ভাই ডা. মহসিন জিল্লুর করিম, বিএনপির দক্ষিণ জেলা শাখার সাবেক সহ-সভাপতি মিজানুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র নিয়েছেন বিএনপি নেতা মোহাম্মদ ইখতিয়ার হোসেন, মোহাম্মদ আল হেলাল, এম এ হাশেম রাজু, এজাজ আহমদ চৌধুরী এবং জাকির হোসেন।

চট্টগ্রাম-১১ আসনে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য তরুণ নেতা ইসরাফিল খসরু চৌধুরী। তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর পুত্র। এ ছাড়া নগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানসহ আরো কয়েকজন নেতা এ আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের প্রার্থী থাকার পরও যারা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন তাদের প্রত্যাশা দল তাদের মূল্যায়ন করবে। কোন কোন আসনে শেষ সময়ে এসে প্রার্থী বদল হতে পারে এমন আশায়ও অনেকে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ দলের গুরুত্বপূর্ণ কোন পদে আসীন হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে আলোচনায় থাকার কৌশল নিয়েছেন। তবে দলের কেন্দ্রীয় একজন নেতা জানান, আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে এককপ্রার্থী দিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই অবস্থায় দলে কোন ধরনের বিভক্তি কাম্য নয়। যারা দলীয় সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দল কোন দ্বিধা করবে না।