এক দিনেই পাল্টে গেল বাংলাদেশের রাজনীতির সব হিসাবনিকাশ। ২৫ ডিসেম্বরের আগে আলোচনা ছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে আসবেন কি না। ১২ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও জনমনে প্রশ্ন ছিল-ভোট হবে কি না? মব সন্ত্রাস বন্ধ হবে কি না? আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে কি না? দেশবাসীর কাছে সব প্রশ্নের উত্তর এখন স্পষ্ট। ১৭ বছর পর দেশে ফিরে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে তাঁর বক্তৃতা রাজনীতির সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশবাসী ইতিবাচক চিন্তা করতে শুরু করেছে। বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচন বানচালের আর কোনো ষড়যন্ত্র কাজ হবে না। শুধু দেশের মানুষ ও রাজনৈতিক দল নয়, বিদেশি গণমাধ্যম তারেক রহমানকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। এ ছাড়া এত দিন নির্বাচন নিয়ে জোটগত যে হিসাবনিকাশ ছিল, তা-ও গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে পাল্টে গেছে রাজনীতির হিসাব।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারের সময় কারামুক্ত হয়ে দেশ ছাড়েন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারেক রহমান দেশে ফেরার ঘোষণা দিলেও ছিল নানান জল্পনাকল্পনা। ছিল চায়ের টেবিলে আলোচনা, টেলিভিশনের টক শোতে বিতর্ক। বুধবার মধ্যরাতে তিনি লন্ডন থেকে দেশের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর সব জল্পনার অবসান ঘটে। ১৭ বছর পর তিনি যখন দেশে ফেরেন, তখনো দেশের ক্ষমতায় একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার। ভোট দেওয়ার, গণতন্ত্রে ফেরার আশা নিয়ে নির্বাচনের অপেক্ষায় বাংলাদেশের মানুষ। বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন তিনি ঢাকার মাটিতে পা রাখেন, বাংলাদেশ অনেকটাই বদলে যায়। তারেক রহমান দেশে ফেরায় নেতা-কর্মীদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। ভোটের আগে বিরাট জমায়েত ঘটিয়ে নজিরবিহীন সংবর্ধনার মাধ্যমে দেশবাসীকে বিশেষ বার্তা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ ছাড়া গতকাল ১৯ বছর পর রাজধানীর শেরেবাংলানগরে চন্দ্রিমা উদ্যানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত করেন তারেক রহমান। সেখানেও নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষের ঢল নামে। এসব উপস্থিতি নির্বাচন ঘিরে দেশবাসীকে বিশেষ বার্তা দিচ্ছে। মাজার প্রাঙ্গণে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাতে অংশ নেন। জিয়ারত শেষে কিছুক্ষণ নীরবে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লে তাঁর চোখে জল দেখা যায়।
দেশবাসী মনে করছেন, নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় ছিল তা এখন কেটে গেছে। ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কোনো ষড়যন্ত্রই বানচাল করতে পারবে না। ক্ষমতা দখলের জন্য বিশেষ মহলের উচ্ছ্বাসে ভাটা বাড়ছে।
বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গতকালের প্রধান খবর ছিল তারেক রহমানের রাজসিক প্রত্যাবর্তন। আলজাজিরাসহ বেশ কয়েকটি গণামাধ্যমে তাঁকে আগামীর প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করা হয়। রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে শিরোনাম করেছিল ‘নির্বাচনের আগে নির্বাসন থেকে ফিরলেন বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী’। সংবাদ সংস্থাটি বলছে, তারেক রহমানের এ ফেরা তাঁর সমর্থকদের মধ্যে অভূতপূর্ব উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে এবং তিনি এখন প্রধানমন্ত্রী পদের প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির শিরোনাম ছিল ‘সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বাংলাদেশে পৌঁছেছেন’। সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এই উত্তরসূরি বিপুল জনসমর্থন আর উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে দেশে ফিরেছেন, যা আগামী নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
এদিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাঁকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করে শিরোনাম করে বলেছে, ১৭ বছর নির্বাসনে থাকার পর দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। বিবিসি বলেছে, ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে থাকা তারেক রহমানই হতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রনায়ক।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে তারেক রহমানের এ ফেরা কেবল একটি সাধারণ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নয়, বরং এটি বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রে ফেরার একটি বড় ধাপ। বিশ্বের অধিকাংশ শক্তিশালী গণমাধ্যম মনে করছে, তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি আগামী নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পথে অনেকটা এগিয়ে গেল। ১৭ বছরের মামলা, হামলা আর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে তাঁর এই রাজসিক প্রত্যাবর্তনকে ‘পরিবর্তনের প্রতীক’ হিসেবে দেখছে বিশ্ব সম্প্রদায়। বৃহস্পতিবার সংবর্ধনা মঞ্চে তারেক রহমান সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন। রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্যে প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। তাঁরা বলেছেন, ‘তারেক রহমানের আগমন দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা আরও সুসংহত করবে। রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করবে।
এদিকে নির্বাচন ঘিরে প্রায় ৩০০ আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শিগগিরই মনোনয়ন না পাওয়া নেতাদের সঙ্গে কথা বলে সারা দেশে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামাবেন। অন্যদিকে নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে কলেবর বাড়তে পারে ইসলামী আটদলীয় জোটের। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আসন সমঝোতা হতে যাওয়া দলগুলোর সঙ্গী হবে এনসিপি-এমনটাই বলছেন আট দলের নেতারা। তবে চূড়ান্ত ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও দু-এক দিন।
মনোনয়নপত্র উত্তোলনের শেষ দিন পর্যন্ত সমঝোতা না হলে প্রত্যাহারের আগেই দলগুলোর মধ্যে আসন সমঝোতা হবে বলে জানান নেতারা। সব মিলিয়ে পাল্টে গেছে নির্বাচনি হিসাবনিকাশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তারেক রহমানের দেশে ফেরা দেশের রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে না থাকার কারণে তিনি যে স্বপ্নগুলো দেখেছেন, প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সেসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি হবে। বিএনপিকে কেন্দ্র করে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে মানুষ।’ প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ার যে পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছেন, দেশবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁর পাশে থাকবেন বলে আশা প্রকাশ করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।